সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ: মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চা | Indian Nationalism: Marxist Historiography

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ: মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চা | Indian Nationalism: Marxist Historiography

ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে শ্রেণী চরিত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন মার্কসীয় পণ্ডিতগণ। এ প্রসঙ্গে প্রথম যার নাম উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। কমিনটার্ন-এ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে এন এম গোল্ডবার্গ, রজনীপাম দত্ত, এ আর দেশাই প্রমুখের রচনায় ভারতের জাতীয়তাবাদের মার্কসীয় বিশ্লেষণ লক্ষ্য করা গেছে।

এম. এন. রায় দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন: 'India in Transition' ও 'What do we want', যেখানে তিনি গান্ধীবাদকে প্রতিক্রিয়ার তীব্রতম বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে, গান্ধীজী ভূস্বামী এবং পুঁজিপতিদের স্বার্থে জনগণের বিপ্লবী শক্তি ও চেতনাকে প্রতিহত করতে চেয়েছিলেন। রায়ের মতে ভারতীয় পুঁজিবাদ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল সুতরাং ভারতীয় পুঁজিপতিদের পক্ষে যথার্থ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম পরিচালনা করে একটি বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি করা ছিল প্রায় অসম্ভব। 

এন. এম. গোল্ডবার্গ মনে করেন ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণী ছিল দুর্বল। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নরমপন্থার যুগে এই বুর্জোয়া শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীন রাজনৈতিক কার্যকলাপ তাই ছিল আপোসমুখী। চরমপন্থী পর্যায়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তা এসেছিল পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছ থেকে। তাদের একটা গণতান্ত্রিক চরিত্র ছিল। সে কারণেই তারা আপোষহীন সংগ্রামের ডাক দিয়েছিল। ভি আই পাভলভ বলেছেন মহারাষ্ট্রতে বৃহৎ মারাঠা বুর্জোয়া শ্রেণীর অনুপস্থিতির জন্য সেখানে পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীকে শক্তিশালী করেছিল। তাই সেখানে তিলকের নেতৃত্বাধীন আপোষহীন সংগ্রাম গড়ে উঠতে পেরেছিল। কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদ ছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের নামান্তর। সরকারের সহযোগিতায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের দাবি জানাতে কংগ্রেসের চার দশকেরও বেশি সময় লেগে গেছিল।

রজনীপাম দত্ত তাঁর 'India Today' গ্রন্থে লিখেছেন জাতি এবং জাতীয়তা ছিল বিকাশশীল পুঁজিবাদের ফসল। বিশ্বের সর্বত্রই পুঁজিবাদের উত্থান ও একটি জাতীয় বাজার গড়ে ওঠার বিষয়কে কেন্দ্র করে জাতি, জাতিসত্তা, জাতি রাষ্ট্র ইত্যাদির উত্থান হয়। কিন্তু ভারতে তা হয়নি। ভারতের জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভূস্বামী পুঁজিপতি শ্রেনী, যাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। সুতরাং ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যিক স্বার্থে পরিচালিত জাতীয়তাবাদ। যখনই নিচু স্তর থেকে উঠে আসা সাধারণ মানুষের সংগ্রাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিব্রত ও বিপন্ন করেছে তখনই জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব সাম্রাজ্যবাদের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। 

জাতীয়তাবাদের মার্কসবাদী বিশ্লেষণকে অতিমাত্রায় যান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করেছেন আমলেশ ত্রিপাঠী। তাঁর মতে ভারতবর্ষের মতো বৃহৎ, বিচ্ছিন্ন, জাত-ভাষা-ধর্ম-অঞ্চল নানাবিধ দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ দেশে শ্রেণীভিত্তিক বিশ্লেষণ করা যায় না। এই ধরনের সংকীর্ণ শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদ পরবর্তীকালে এস এন মুখার্জী, সুমিত সরকার ও বিপাণ চন্দ্রের মত মার্কসবাদী দের লেখায় পরিমার্জিত হয়। সুমিত সরকার ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণীর অবুর্জোয়া চরিত্রকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতীয় শিক্ষিতরা ঐতিহ্য অনুসারী 'বুদ্ধিজীবী' হিসেবে কাজ করেছিল। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। তাঁরা উদারনীতিবাদ, জাতীয়তাবাদের মতো বিশ্বভাবাদর্শের আহবানে সাড়া দিয়েছিল। তারা তখনও ছিল ভারতের 'জড়বৎ' জনগণের বিকল্প। Modern India গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন শ্রেণী ও শ্রেণী চেতনা হল বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয় উপকরণ। এগুলিকে আরও দক্ষতার সঙ্গে ও নমনীয় ভাবে ব্যবহার করতে হবে। তিনি জাতীয়তাবাদের বৈধতাকে স্বীকার করেন; কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাপা উত্তেজনার দিকগুলিকে উপেক্ষা করেন না। তিনি বলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের দুটি স্তর ছিল: একটি উচ্চকোটির, অন্যটি জনমুখী। এর কোনটিকেই উপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই দুই স্তরের জটিল পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা দরকার, কেননা এর মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়েছিল পরিবর্তনের মাঝে ধারাবাহিকতার ধাঁচ, এই ধাঁচ ই আমাদের প্রধান উপজীব্য।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...