ভারতীয় জাতীয়তাবাদ: সাম্রাজ্যবাদী ও নব্য ঐতিহ্যবাদী ইতিহাসচর্চা | Indian Nationalism: Colonial Historiography
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে কি বোঝায়?
এ বিষয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একমত যে, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে আধুনিক অর্থে কোন ভারতীয় রাজনৈতিক জাতির অস্তিত্ব ছিল না। এরকম কোনও ধারণা অবচেতনভাবে ভারতবর্ষের সভ্যতার মধ্যে লুকিয়ে ছিল কি না এবং কালক্রমে তার উদ্ভব ঘটেছিল কি না, তা নিয়ে অতীত এবং বর্তমানের জাতীয়তাবাদী নেতা এবং ঐতিহাসিকরা বিতর্কের জড়িয়ে থাকেন। তবে একটা ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এক সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং ১৯৪৭ সালে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে যার জয় সূচিত হয়েছিল। এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছিল 'উপনিবেশিকজাত আধুনিকতা প্রসূত'। উপনিবেশিক পক্ষের বক্তব্য ছিল, তারা উপনিবেশকে সামাজিক অবক্ষয়ের অন্ধকার থেকে তুলে এনে আধুনিক স্তরে উন্নীত করবে। আবার উপনিবেশের অধীনস্থ মানুষের পক্ষেও পশ্চাদদামিতা দূর করে এ কথা প্রমাণ করে দেখানোর খানিকটা দায়ী ছিল যে আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে তারাও একত্রিত হয়ে শাসন কাজ পরিচালনা করার যোগ্য। কাজেই জাতীয়তাবাদের দুটো ধাপ: প্রথমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং তারপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি করা। এ কথা সকলেরই জানা যে, ভারতে ভাষা ধর্ম এবং জাতিগত বৈচিত্র্য ব্যাপক এবং এই বহুধাবিভক্ত ভারতবাসী কিভাবে জাতির কল্পনা করেছিল তা-ই প্রকৃত বিতর্কের বিষয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা মহাত্মা গান্ধীর মত মানুষেরা ভারতীয় সভ্যতার মধ্যে নিহিত যে সর্বজনীনতার বিকল্প ভাষ্যের অবতারণা করেছিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা কিন্তু তাকে গ্রহণ করেননি। পাশ্চাত্যের জাতিরাষ্ট্রের ধাঁচকেই তারা গ্রহণ করেছিলেন।
সাম্রাজ্যবাদী ও নব্য 'ঐতিহ্যবাদী' ব্যাখ্যা
উনিশ শতকে ভারতে একদল শিক্ষিত ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটেছিল। ব্রিটিশ প্রশাসক ও লেখকরা দাবি করেছিলেন যে, তাদের প্রচলিত ইংরেজি শিক্ষাই এই শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা প্রজ্জ্বলিত করতে সাহায্য করেছিল। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের লেখা পড়েই তারা স্বাধীনতার ধারণা লাভ করেছিল। তাঁরা আরও মনে করেন, ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করেছিল: একদিকে ব্রিটিশ শাসকদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজন মিটে ছিল, অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম সংঘটিত করার পথ প্রশস্ত করেছিল। সম্পদ ও শিক্ষায় অগ্রসর মহারাষ্ট্রের চিৎপাবন ব্রাহ্মণরাই প্রায় একচেটিয়াভাবে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদগুলি ভোগ করতেন এবং তারাই আবার জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে ভ্যালেন্টাইন চিরল বলেছেন, ভারতবর্ষ একটি ভৌগোলিক সীমানাবিশিষ্ট এলাকার মাত্র, পাশ্চাত্য ধারনা অনুযায়ী জাতি (nation) এখানে গড়ে ওঠেনি। এখানকার রাজনৈতিক আন্দোলনের শিকড় নিহিত ছিল তাই সনাতন পরিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে। সাধারণ মানুষের স্বার্থের চেয়ে জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের জাতি (caste) বা গোষ্ঠীর স্বার্থকেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অগ্রধিকার দিয়েছিল।
ভ্যালেন্টাইন চিরলের পুরানো সাম্রাজ্যবাদী ব্যাখ্যারই প্রতিধ্বনি সোনা গিয়েছিল ঈঙ্গ আমেরিকার উচ্চশিক্ষায়তনগুলিতে, যাকে রজতকান্ত রায় 'নব্য ঐতিহ্যবাদী ঘরানা' বলে উল্লেখ করেছেন। এই ঘরানার বক্তব্য, ভারতীয় সমাজে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি হয় পরম্পরাগত বিভাজনের রেখাগুলি ধরে, যেমন ভাষাগত, অঞ্চলগত, জাতি-সম্প্রদায় বা ধর্মীয়-সম্প্রদায়গত। আধুনিক জাতি বা শ্রেণীর ধারণা সেখানে ছিল না। এক্ষেত্রে পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক ছিল উপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনগুলি। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য পাশ্চাত্য শিক্ষার এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রচলন। এইসব নতুন সুযোগ পরম্পরাগত ভারতীয় সামাজিক বিভাগকে ছেদ করেছিল। সৃষ্টি করেছিল পাশ্চাত্য শিক্ষিত ও মর্যাদা বিশিষ্ট উচ্চকোটির এক নতুন সামাজিক গোষ্ঠী। সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত এদেশীয়রাই এই গোষ্ঠীতে থাকত, যেমন বাংলার ভদ্রলোক, বোম্বাইয়ের চিৎপাবন ব্রাহ্মণ এবং মাদ্রাজের তামিল ব্রাহ্মণেরা। এই সীমিত রাজনৈতিক জাতির বাইরে ছিল পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের সুবিধাহীন মানুষেরা। উপনিবেশিক ভারতের আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে তাদের কোন প্রবেশাধিকার ছিল না, অথচ এই প্রাতিষ্ঠানিক চৌহদ্দির মধ্যেই প্রথম ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বার্তা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীর গণজাতীয়তাবাদের পূর্ব পর্যন্ত এই অবস্থা চলেছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন