কেমব্রিজ ইতিহাসচর্চা | Indian Nationalism : Cambridge Historiography
এ বিষয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একমত যে, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে আধুনিক অর্থে কোন ভারতীয় রাজনৈতিক জাতির অস্তিত্ব ছিল না। এরকম কোনও ধারণা অবচেতনভাবে ভারতবর্ষের সভ্যতার মধ্যে লুকিয়ে ছিল কি না এবং কালক্রমে তার উদ্ভব ঘটেছিল কি না, তা নিয়ে অতীত এবং বর্তমানের জাতীয়তাবাদী নেতা এবং ঐতিহাসিকরা বিতর্কের জড়িয়ে থাকেন। তবে একটা ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এক সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং ১৯৪৭ সালে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে যার জয় সূচিত হয়েছিল। এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছিল 'উপনিবেশিকজাত আধুনিকতা প্রসূত'। উপনিবেশিক পক্ষের বক্তব্য ছিল, তারা উপনিবেশকে সামাজিক অবক্ষয়ের অন্ধকার থেকে তুলে এনে আধুনিক স্তরে উন্নীত করবে। আবার উপনিবেশের অধীনস্থ মানুষের পক্ষেও পশ্চাদদামিতা দূর করে এ কথা প্রমাণ করে দেখানোর খানিকটা দায়ী ছিল যে আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে তারাও একত্রিত হয়ে শাসন কাজ পরিচালনা করার যোগ্য। কাজেই জাতীয়তাবাদের দুটো ধাপ: প্রথমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং তারপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি করা। এ কথা সকলেরই জানা যে, ভারতে ভাষা ধর্ম এবং জাতিগত বৈচিত্র্য ব্যাপক এবং এই বহুধাবিভক্ত ভারতবাসী কিভাবে জাতির কল্পনা করেছিল তা-ই প্রকৃত বিতর্কের বিষয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা মহাত্মা গান্ধীর মত মানুষেরা ভারতীয় সভ্যতার মধ্যে নিহিত যে সর্বজনীনতার বিকল্প ভাষ্যের অবতারণা করেছিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা কিন্তু তাকে গ্রহণ করেননি। পাশ্চাত্যের জাতিরাষ্ট্রের ধাঁচকেই তারা গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭০ এর দশকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ঐতিহাসিক নতুন আলোকে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। ঐতিহাসিকদের কাছে এরা ক্যামব্রিজ গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক নামে পরিচিত।
কেমব্রিজ গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকরা ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অস্তিত্বের প্রকৃতি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলেছেন যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলনের পরিবর্তে উপনিবেশিক ভারতে ঘটেছিল একের পর এক স্থানীয় আন্দোলন। সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা ছিল দুর্বল। তারা ভারতীয় সহযোগীদের ছাড়া প্রশাসনিক কাজকর্ম চালাতে পারত না। এই দুর্বল সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে যে জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটেছিল সেই জাতীয়তাবাদও ছিল দুর্বল। তাই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম আসলে পিকউইকের লড়াই ছাড়া অন্য কিছু নয়। যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী শাসন ব্যবস্থা ভারতীয়দের সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল ছিল সেহেতু উপনিবেশিক শাসকদের প্রসাদ পাওয়ার একটি প্রবণতা ভারতীয় সহযোগীদের মধ্যে দেখা যেত এবং তা নিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো। এর ফলে নানান রকম কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল। ব্রিটিশ সরকার এদেশে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা ও নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করে আরো অধিক সংখ্যক সহযোগীদের দলে টানার চেষ্টা করে। এই সুযোগে ওইসব স্বার্থগোষ্ঠীগুলি তাদের সমর্থকবৃন্দ বাড়াতে শুরু করে দেয়। এইসব সংকীর্ণ ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থান্বেষী নেতারাই ছিল জাতীয় আন্দোলনের পরিচালক। বিভিন্ন স্তরে নেতারা নিজেদের মধ্যে পৃষ্ঠপোষক ও পোষ্যবৃন্দের সম্পর্কে সম্পর্কিত ছিল। ওপর থেকে নিচু পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের আনুগত্যের মধ্য দিয়েই এইসব নেতারা ক্ষমতা ও পৃষ্ঠপোষকতা ভোগের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশের সঙ্গে দরকষাকষি করতেন।
সুতরাং কেমব্রিজ ঘরানার ইতিহাস চর্চা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভূমিকাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করল। প্রখ্যাত কেমব্রিজ ঐতিহাসিক অনিল শীল লিখেছেন, Ideology provides a good tool for fine carving, but it does not make big buildings. এই ঘরানা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে প্রতিযোগিতা-সহযোগিতামূলক আচরণের সমন্বয়ের প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করতে চাইলো। তাদের মতে ভারতবর্ষে কোন জাতি ছিল না। মূলত ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সমবায় ছিল। তারা একত্রিত হয়েছিল এই কারণে যে, তাদেরকে ব্রিটিশ সৃষ্ট একটি কেন্দ্রীভূত জাতীয় কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হত। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিষয়ক ইতিহাস সম্বন্ধে এরকম নিন্দাবাদী বিশ্লেষণ মন ও আবেগের ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। তাই তপন রায় চৌধুরী বলেছেন, এই কেমব্রিজ ঘরানা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে একেবারেই 'জন্তু-জানোয়ারের রাজনীতি'র পর্যায়ে নামিয়েছে এনেছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন