ভারতের ইতিহাসে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের গুরুত্ব
মহান সম্রাট আকবরের পুত্র এবং তার পরবর্তী মুঘল শাসক ছিলেন জাহাঙ্গীর। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের মৃত্যু হলে জ্যেষ্ঠ পুত্র সেলিম ৩৬ বছর বয়সে আগ্রা দুর্গে নুরুদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে মুঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। আকবরের রাজত্বকালের অগ্রগতির সঙ্গে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালকে তুলনা করা যায় না ঠিকই, কিন্তু মুঘলদের যে ঐতিহ্য-- ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংস্কৃতিমনস্কতা-- তা থেকে জাহাঙ্গীর এক ইঞ্চিও সরে আসেননি।
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল পুত্র খসরুর বিদ্রোহ (১৬০৭)। আকবরের মৃত্যুর পর সভাসদদের অনেকেই সেলিমের পরিবর্তে আকবরের পৌত্র খসরুকে সিংহাসনের উপযুক্ত মনে করেছিলেন। সুতরাং খসরুর যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও ছিল। মানসিংহ, আজিজ কোকা, শিখ গুরু অর্জুন খসরুর পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খসরুর বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে যুবরাজ খুররমের হাতে খসরুর মৃত্যু হয়েছিল।
যে ঘটনার জন্য জাহাঙ্গীরকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে সেটি হল নুরজাহানের সঙ্গে তার বিবাহ। পারসিক কন্যা নুরজাহান জাহাঙ্গীরের দরবারে অগ্রমহিষীর মর্যাদাও পেয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেন যে পর্দার আড়াল থেকে কার্যত নুরজাহানই শাসন পরিচালনা করতেন। জাহাঙ্গীর ছিলেন কেবল কাঠের পুতুলমাত্র। নুরজাহানের সংকীর্ণ রাজনীতির জন্যই (যা নুরজাহান চক্র নামে পরিচিত) দরবারে দলীয় দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল এবং এই দ্বন্দ্বের ফলেই প্রবীণ নেতা মহব্বত খাঁ বিদ্রোহ করেছিলেন এবং কান্দাহার হস্তচ্যুত হয়েছিল।
জাহাঙ্গীরের প্রথম অভিযান ছিল মেবারের রানা অমর সিংহের বিরুদ্ধে। মেবারের বিরুদ্ধে প্রথম দুটি অভিযান ব্যর্থ হলেও তৃতীয় তথা শেষ অভিযানটি মোটামুটি ভাবে সফল হয়েছিল এবং রানার সঙ্গে জাহাঙ্গীর একটি সম্মানজনক চুক্তিও করেছিলেন। আকবরের পথ অনুসরণ করেই তিনি যথেষ্ট রাজনৈতিক সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। জাহাঙ্গীরের পরবর্তী অভিযান প্রেরিত হয়েছিল বঙ্গদেশের বিরুদ্ধে। ইসলাম খানের যোগ্য তত্ত্বাবধানে বারো ভূঁইয়াদের পরাজিত করে বঙ্গদেশের উপরে মুঘল কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। তবে জাহাঙ্গীর দাক্ষিণাত্যে তেমন সফল হতে পারেননি। এতদিন আহম্মদনগরের কিছু অংশই মুঘলদের অধীনে ছিল। ব্যপক অভিযান সত্ত্বেও সেখানে নিজাম শাহী বংশের বিলুপ্তি সাধন করতে পারেননি। শুধু দাক্ষিণাত্য নয়, তাঁর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতিও ব্যর্থ হয়েছিল। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে পারস্য এর শাহ কান্দাহার দখল করে নিয়েছিলেন এবং সেই সময়ে মুঘল দরবারে শাহরিয়ার বনাম খুররম দ্বন্দ্ব এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে কান্দাহার শেষ পর্যন্ত মোগলদের হস্তচ্যুত হয়েছিল।
জাহাঙ্গীর মানুষের বৈষয়িক উন্নতির জন্য কোনো ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। কিন্তু তাঁর রাজত্বকাল অর্থনৈতিক দিক থেকে খুব একটা খারাপ ছিল না। তার সময় দেশের মানুষের অর্থনৈতিক শ্রবৃদ্ধি ঘটেছিল, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য প্রসার লাভ করেছিল। জনসাধারণকে উপবাসে কাটাতে হয়নি।
তবে জাহাঙ্গীর সামাজিক অভিশাপ দূর করার জন্য এবং একাধিক জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী গ্রহণ করেছিলেন। ন্যায় বিচার প্রদানের জন্য তার খ্যাতি ছিল। ন্যায় বিচারের উদ্দেশ্যে রাজ দরবারে তিনি ঘন্টা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। যে কেউ সুবিচারের জন্য এই ঘন্টা বাজিয়ে সম্রাটের কাছে উপস্থিত হতে পারত। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য জাহাঙ্গীরের সতর্ক দৃষ্টি ছিল এবং অপরাধীরা কঠোর দণ্ডে দণ্ডিত হত। তবে প্রাণদণ্ড খুব সতর্কতার সঙ্গে দেওয়া হত। তাই সহজেই বোঝা যায় তিনি স্বভাবনিষ্ঠুর ছিলেন না। তবে মাঝে মাঝে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতেন।
জাহাঙ্গীর আকবরের মতই ধর্ম ব্যাপারেও উদার ছিলেন। তিনি মুসলমান ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ধর্ম ব্যাপারে তার কোনো গোড়ামী ছিল না। তবে মাঝে মাঝে এমন কিছু আচরণ করেছেন যার ফলে তার ধর্মনীতি সম্পর্কে কোন কোন ঐতিহাসিক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি হোলি উৎসবে যোগদান করতেন, হিন্দু যোগীদের সঙ্গ দিতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও জ্বালামুখীর মন্দিরে তার আচরণ ও শিখ গুরু অর্জুনের হত্যার ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে তিনি নতুন মন্দির ও খ্রিস্টানদের চার্চ অবাধে নির্মাণ করতে দিয়েছিলেন। যদিও সামরিক অভিযানের সময় সেনাবাহিনীর দ্বারা ধর্মীয় স্থান কোন কোন স্থানে লাঞ্ছিত হয়েছে। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের তীর্থস্থান পরিদর্শনের অবাধ অধিকারে তিনি কখনো বাধা দেননি, জিজিয়া পুনর্বহাল করেননি এবং তীর্থযাত্রীকর তিনি আরোপ করেননি। শিখদের প্রতি জাহাঙ্গীরের মনোভাব বিতর্কিত হলেও কোন ধর্মীয় উন্মাদনার বসে নয়, গুরু অর্জুনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল কারণ তিনি পুত্র খসরুর বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
শিল্প ও সাহিত্যের ব্যাপারে তিনি চরম পৃষ্ঠপোষকতার পরিচয় দিয়েছেন। তার আমলে মুঘল চিত্রকলা গৌরবের চরম শিখরে আরোহন করেছিল। তার সময়ে ভারতের ও পারস্যের বিখ্যাত চিত্রকররা তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। তিনি ফারসি ও তুর্কি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল। তার লেখা তুজুক ই জাহাঙ্গীরি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ।
তাই সবদিক থেকেই বিবেচনা করে এ কথা বলাই যায়, মোটের উপর জাহাঙ্গীর একজন সফল শাসক ছিলেন। পিতার দেওয়া সাম্রাজ্যকে তিনি অটুট রাখতে পেরেছিলেন, প্রজাকল্যাণের ব্যবস্থা করেছিলেন, পিতার প্রদর্শিত পথেই মুঘল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। রাষ্ট্রীয় জীবনে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তার সময় একাধিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূত রাজদরবারে এসেছিলেন এবং সম্রাটের অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন