একমেরু ব্যবস্থা
দ্বিমেরুতার অবসানের অনিবার্য ফলশ্রুতি ছিল একমেরু বিশ্ব ব্যবস্থার উদ্ভব। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক পশ্চিমী জোট এবং সাম্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতি চলে আসছিল তার ফলে যে দ্বিমেরুকৃত বিশ্ব ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটেছিল সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনের ফলে এই প্রতিদ্বন্দ্বীতার অবসান ঘটে। মার্কিনের প্রতিদ্বন্দী আর কোনো পরাশক্তির অস্তিত্ব থাকল না আর। এই নতুন বিশ্বব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞগন একমেরুতা বলে উল্লেখ করেছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা বিশ্ব রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা তার করতলগত হয়ে উঠেছিল। যতই বিতর্কিত হোক না কেনো মার্কিনের বিদেশ নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত কেউ ছিল না, যেখানে ইতিপূর্বে ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য একটা ভারসাম্য বজায় ছিল। ১৯৯০-৯১ খ্রীঃ উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের বিরুদ্ধে বিশাল জয়লাভের ফলে মার্কিনের আত্মবিশ্বাস ও বেপরোয়া মনোভাব তুঙ্গে উঠেছিল। মার্কিন অস্ত্রসম্ভারের নিত্যনতুন সংযোজন তার প্রতিপত্তি ব্যপক হারে বৃদ্ধি করেছিল। পেট্রিয়ট ক্ষেপনাস্ত্রের সাফল্য এবং অন্যান্য উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন সমরাস্ত্রের উদ্ভাবন মার্কিনের সামরিক প্রাধান্য নিরঙ্কুশ করে তুলেছিল। এখন থেকে তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে মার্কিন অস্ত্র কেনার অশুভ প্রবনতা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেল। অস্ত্র বিক্রির সুবাদে ওয়াশিংটন অপ্রত্যাশিত বাড়তি সুবিধাপ্রাপ্ত হল।
এই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকা ছাড়া কেবল ধনী দেশগুলির একমাত্র সম্মান ছিল। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলি একেবারে উপেক্ষিত হল। রাষ্ট্রসংঘ একপ্রকার তার ক্রীড়নকে পরিনত হয়। আমেরিকা তার আধিপত্যবাদকে আরো মজবুত করার জন্য বিশ্ব ব্যাংক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার প্রভৃতি সহযোগী সংস্থা ও বিশ্বায়ন এবং উদারীকরণের মতো অর্থনৈতিক ধারণাও ব্যবস্থাকে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়।
পরিশেষে বলা যায়, এই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকা তার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো রকম ঘৃণ্য পদক্ষেপ গ্রহণেও দ্বিধাগ্রস্থ ছিল না। সে তার অনুগামী ও শত্রু রাষ্ট্রের তালিকা তৈরি করে ফেলে এবং শত্রু রাষ্ট্রকে বিধ্বস্ত করতে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে চলে, যার প্রমাণ পাওয়া যাবে সাদ্দাম হোসেনের ইরাককে ধ্বংস করে দেওয়া বা আফগানিস্তানের স্বাধীনতা হরনের ঘটনায়। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশগুলিকে মার্কিন অনুগামী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার মার্কিন বিরোধিতার কোন নামগন্ধ যাতে না থাকে তার জন্য সচেষ্ট হয়। আর এজন্যই উত্তর কোরিয়া ও ইরান তাদের চোখে 'শয়তানের অক্ষ'-এ পরিনত হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন