সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত | Impact of World War-- I in India

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত ভারতের উপর কিভাবে পড়েছিল? 

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির বিরুদ্ধে বৃটেনের যুদ্ধ ঘোষণার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। বৃটেনের উপনিবেশে হিসাবে ভারত অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবং খানিকটা অজান্তেই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতের বহু মানুষ ও সম্পদকে এই যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে ভারতের উপর যুদ্ধজনিত চাপের অনেকাংশই পড়ে, যার প্রতিফল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায়। ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অধিকাংশ ব্রিটিশদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা করেন, যুদ্ধান্তে স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার আশায়।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেশবাসীকে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ফেলে দেয়। যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে সামরিক খরচ বেড়ে যায়। ফলে যুদ্ধ বাবদ ঋণ প্রচুর পরিমানে বেড়ে যায়। ফলে কর আদায়ের বেড়ে যায়। ভূমিরাজস্ব স্থিরীকৃত হয়ে গিয়েছিল বলেই ব্যবসা ও শিল্পের উপর পরোক্ষ কর বাড়ি দেওয়া হয়। এই করের বোঝা শেষ পর্যন্ত পড়ে সাধারণ মানুষের উপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে। অংশত পরোক্ষ কর, অংশত পরিবহন ও অন্যান্য আর্থিক অচলাবস্থার কারণে ভয়ংকর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি দেখা দেয়। ১৯১৮-১৯ ও ১৯২০-২১ সালে দুবার অনাবৃষ্টির ফলে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তার উপর সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য চালান হবার ফলে খাদ্যাভাব আরো প্রকট হয় এবং দেশে দুর্ভিক্ষকে সৃষ্টি হয়। ১৯১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ ও সংক্রামক ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে প্রায় ১২ থেকে ১৩ বিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটে।


কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলেও ধনী কৃষকরা কোন সুবিধা পায়নি; কারণ রপ্তানিকৃত কৃষিজ কাঁচামালের দাম সমান তালে বৃদ্ধি পায়নি। তাই বহু ধ্বনি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জমি হারিয়ে ভাড়াতে কৃষকে পরিণত হয়


শিল্প শ্রমিক শ্রেণীও সমভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। যুদ্ধের সময় বিদেশি পণ্য আমদানি বন্ধ থাকায় দেশীয় শিল্পীর বিকাশ দ্রুত হয়। ফলে শ্রমিক নিয়োগের পরিমাণ বাড়ে। কিন্তু যুদ্ধান্তে আবার আমদানি চালু হওয়ার স্বদেশী শিল্প দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। প্রতিবাদের শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। ১৯১৯-২১ এর মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয়। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতের অর্থনৈতিক নির্গমন ঘটিয়ে সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে চরম বিপাকে ফেলে


সামাজিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মত। ১৯১৪ থেকে গ্রামাঞ্চল থেকে বাধ্যতামূলক সেনা সংগ্রহ শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে ক্রমশ প্রতিবাদ ধুমায়িত হতে থাকে। যুদ্ধফেরত সৈন্যরা সঙ্গে করে নিয়ে আসে নতুন যুগের উন্মাদনার সংবাদ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় বাংলার কবি নজরুল এর কথা, যিনি সমাজতান্ত্রিক উদারনৈতিক ভাবধারার দ্বারা প্রথম উদ্বুদ্ধ হন মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের, বিশেষত যুবকদের মধ্যে যুদ্ধের মারণলীলা পাশ্চাত্যের নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার প্রতি মোহভঙ্গ ঘটায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণআন্দোলনগুলি তাদেরকে উদ্দীপিত করে। ১৯১৭ তে রাশিয়ার বলসেভিক বিপ্লব ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ভারতের যুবকদেরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ভারতের কমিউনিস্টদের উত্থানের পথ সূচিত হয়।


বিশ্বযুদ্ধ জনিত বিশেষত অর্থনৈতিক চাপের মোকাবিলা করতে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর কাছে কিছুটা দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে। ভারতীয়দের বিশেষত শিক্ষিত এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন অংশকে খুশি করার জন্য কিছু ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজন দেখা দেয়। যুদ্ধ চলাকালীন কংগ্রেস মুসলিম লীগ ও হোমরুল লীগের নেতৃবৃন্দ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেছিল। যুদ্ধান্তে ভারত সচিব মন্টেগু ও ভাইসরয় চেমসফোর্ড যৌথ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয়দেরকে শাসন সংস্কার প্রদান করা হয় (1919 এর ভারতশাসন আইন)। এই আইনে শাসন ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বেশি করে অধিকার দেওয়া হয়।


পরিশেষে বলা যায় বিশ্বযুদ্ধ একদিকে যেমন ভারতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, তেমনই ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করেছিল। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন রূপকে উপলব্ধি করে এবং সরকার বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...