সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্বরাজ দল ও বাংলার রাজনীতি | Swaraj Party in Bengal Politics

 স্বরাজ দল ও বঙ্গ রাজনীতি

বারদৌলি সিদ্ধান্ত (১৯২২) ও অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পর কংগ্রেসের ভিতরে গান্ধিপন্থী কৌশলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহেরু প্রমূখ নেতৃবৃন্দ প্রস্তাব দিতে থাকেন যে, ব্যবস্থাপক সভাগুলিতে কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করা উচিত। ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতায় কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটির সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তী নীতি নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেস সদস্যরা গয়া অধিবেশনে মিলিত হন। মতিলাল নেহরু ও চিত্তরঞ্জন দাস প্রস্তাব দেন যে, ব্যবস্থাপক সভা বয়কট না করে বরং সেখানে প্রতিনিধিত্ব করে কংগ্রেস সদস্যরা সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের প্রকৃত রূপ উদঘাটিত করুক। ব্যবস্থাপক সভারগুলির কার্যাবলিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ভিন্ন পন্থায় সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করার কথাই চিত্তরঞ্জন দাস এবং মতিলাল নেহেরু বলেছিলেন। কিন্তু এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বল্লভ ভাই প্যাটেল রাজেন্দ্রপ্রসাদ রাজাগোপালাচারী প্রমূখরা পুরানো নীতির পক্ষেই ছিলেন। গয়া অধিবেশনে পরিবর্তনপন্থীরা ভোটে পরাজিত হন। চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু কংগ্রেসের যে পদগুলিতে ছিলেন সেগুলি থেকে ইস্তফা দেন এবং ১৯২৩ সালের ১লা জানুয়ারি তারা একটি নতুন স্বরাজ দল গঠনের কথা ঘোষণা করেন। বলা হয় যে এই নতুন দল কংগ্রেসের মধ্য থেকেই কাজ করবে।

১৯২৩ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত সময়কালের অধিকাংশ সময়ই গান্ধি জেলে ছিলেন তাই এই সময় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে স্বরাজ দল মূখ্য ভুমিকা পালন করেছিলেন। বাংলার রাজনীতিতে স্বরাজ দল এই পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯২৩ সালের নির্বাচনে স্বরাজ দল বাংলায় খুব ভালো ফল করেছিল। হিন্দু ও মুসলমানদের সাধারণ ৮৫ টি আসনের মধ্যে স্বরাজ দল ৪৭ টি আসন লাভ করেছিল এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসনের ২১ টি আসনে তারা জয়ী হয়েছিল। এর থেকে সহজেই অনুমান হয় যে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই চিত্তরঞ্জন দাশের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। চিত্তরঞ্জন দাশের সুদক্ষ নেতৃত্বেগুনেই সমকালীন হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় কিছুটা রাশ টানা সম্ভব হয়েছিল। বাংলার হিন্দু ও মুসলমানরা একটি পারস্পরিক সমঝোতায় এসেছিল, যা বেঙ্গল প্যাক্ট নামে পরিচিত। ১৯২৩ এর এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে স্বরাজ লাভের পর বাংলার প্রশাসনিক পদগুলির ৫৫% সংরক্ষিত থাকবে মুসলমানদের জন্য। হিন্দুরা মসজিদের সামনে গান-বাজনা বন্ধ করবে এবং বকর-ঈদের দিন গোহত্যা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। বেঙ্গল প্যাক্ট এর শর্তাবলী বাংলাদেশে আন্তরিকভাবেই মানা হয়েছিল। যদিও কংগ্রেসের কাকিনাড়া অধিবেশন এই চুক্তির মান্যতা দেয়নি। বেঙ্গল প্যাক্টে সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় প্রতিফলিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু সমসাময়িককালে জাতির প্রধান সমস্যার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে স্বরাজ দল যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিল।

তবে সরকারের বিরোধীতার ক্ষেত্রে স্বরাজ দল বিশেষ সাফল্য পায় নি। ইতিমধ্যে ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু হয়। তারপর দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাংলায় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও সুভাষ চন্দ্র বসুর গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব মারাত্মক আকার ধারন করে। ১৯২৬ এর নির্বাচনে স্বরাজীরা খারাপ ফল করে। ইতিমধ্যে বাংলায় হিন্দু স্বরাজীরা নির্দল প্রার্থীদের সাথে সমঝোতা করে। ফলে কিছু আসন তারা লাভ করে। উক্ত কারণে এবং আরো অন্যান্য কারণে মুসলমানেররা স্বরাজীদের প্রতি আর ভরসা রাখেনা। এই ভাবে স্বরাজীরা ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...