সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্বদেশী আন্দোলন | Swadeshi Movement

 স্বদেশী আন্দোলন

কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বাঙালি তথা ভারতবাসী মেনে নেয়নি। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের বাঙালি প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল। এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন রাজপথ থেকে হেঁসেল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। আন্দোলন কেবলমাত্র রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সাহিত্য,শিল্পকলা, সঙ্গীত, বিজ্ঞান-- সর্বত্র এই আন্দোলন বিস্তৃত হয়েছিল।

১৯০৩ সালে ডিসেম্বর মাসে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ওঠা থেকে শুরু করে ১৯০৫ সালে জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা পর্যন্ত আন্দোলন নরমপন্থী কার্যকলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে একাধিক প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হয়েছিল। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, কৃষ্ণ কুমার মিত্র প্রমুখরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় (বেঙ্গলি, সঞ্জীবনী প্রভৃতি) প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ভারত সচিবের কাছে বঙ্গভঙ্গ রদ করার দাবি নিয়ে অসংখ্য স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এই সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল। যখন বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হল, ১৯০৫ সালের ৭ ই আগষ্ট, টাউনহলের এক সভায় সুরেন্দ্রনাথের প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও আন্দোলনের পরবর্তী পন্থা হিসেবে ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের  সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এইভাবে নরমপন্থী ঐতিহ্যের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তিনটি পৃথক ধারায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলতে থাকল-- 

 ১. গঠনমূলক স্বদেশী 

২. রাজনৈতিক চরমপন্থা বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ 

৩. বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ।

 প্রথম ধারাটি অর্থাৎ গঠনমূলক স্বদেশীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল স্বদেশী শিল্প, জাতীয় শিক্ষা আর গ্রাম উন্নয়ন ও সংগঠনের মাধ্যমে আত্মসহয়তায অর্জনের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা, যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন আত্মশক্তি। গঠনমূলক স্বদেশীকে কেন্দ্র করে বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিলের মত স্বদেশে কাপড়ের কল, উন্নত মানের তাঁত, চিনামাটি, চামড়া, সাবান প্রভৃতি কারখানা, এমনকি জাহাজ নির্মাণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যাল গড়ে তুলেছিলেন। তবে বেশিরভাগ উদ্যোগগুলি মূলধন ও অভিজ্ঞতার অভাবে সফল হয়নি। স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের আর্জি জানিয়ে প্রচার করতেন।

গঠনমূলক স্বদেশীর আরেকটি দিক ছিল জাতীয় শিক্ষা। সতীশ চন্দ্র মুখার্জী তাঁর ডন (Dwan) পত্রিকায় দেশীয় শিক্ষা বিস্তারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর ডন সোসাইটি ব্রিটিশ প্রভাব মুক্ত শিক্ষার ব্যাপারে যে চর্চার সূচনা করেছিল তাতে রবীন্দ্রনাথেরও অবদান ছিল। লর্ড কার্জনের বিশ্ববিদ্যালয় আইন, কার্লইল সার্কুলার প্রভৃতি দমনমূলক আইন জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনকে সক্রিয় করেছিল। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে গড়ে উঠেছিল বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ এবং বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট। একাধিক জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে ৩০০ টি ছিল প্রাথমিক এবং ২৫ টি ছিল মাধ্যমিক। জাতীয় বিদ্যালয়গুলির অন্যতম লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটানো। তবে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ ছিল। তাই দীর্ঘদিন ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনে ধরে রাখার ব্যাপারটি যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ছিল।

গঠনমূলক স্বদেশীর আরেকটি অন্যতম অঙ্গ ছিল গ্রামোন্নয়ন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশী সমাজ  শীর্ষক ভাষণে বলেছিলেন, গ্রামে যদি সমবায় কৃষি ব্যাংক, বিক্রয় ভান্ডার, শিল্প- বিদ্যালয় গড়ে তোলা যায়, সরকারি পুলিশ এবং জমিদারের পেয়াদার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নৈতিক শক্তি গ্রামবাসীর মধ্যে গড়ে তোলা যায় তবে ইংরেজ সরকারকে বিপাকে ফেলা যাবে। অশ্বিনী কুমার দত্তের বরিশালে স্বদেশ বান্ধব সমিতি গড়ে তুলেছিল। এই সমিতি ইংরেজ সরকারের আদালতে দ্বারস্থ না হয়ে গ্রামীণ বিবাদ সালিশির মাধ্যমে মিটিয়ে দেওয়ার পক্ষে গুরুত্ব আরোপ করেছিল।

দ্বিতীয় ধারাটি ছিল রাজনৈতিক চরমপন্থা। এই ধারার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিলক ও অরবিন্দের মতো নেতারা ,যারা পূর্ণ স্বরাজের লক্ষ্যে বয়কটকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এই ধারায় বিদেশী পণ্য, বিদেশী শিক্ষা, আইন, আদালত, পৌরসভা, আইন পরিষদ বর্জনের কথা বলা হয়। জনগণকে বয়কট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য চরমপন্থীরা ধর্মীয় পুনঃজাগরনবাদের উপর জোর দিয়েছিলেন। এর ফলে মুসলমান সম্প্রদায় এবং বৈষ্ণবরা কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিল। জনমত গঠনের দ্বিতীয় পন্থা হিসেবে বহু সমিতি গঠিত হয়েছিল। যেখানে যুবাদের শারীরিক ও নৈতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখানে সমস্যা ছিল যে সমিতির বেশিরভাগ সদস্যই ছিল উচ্চ জাতির হিন্দু ভদ্রলোক যাদের সঙ্গে নিম্নবর্গের মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল নিপীড়ন মূলক। নিম্নবর্গের মানুষ আরো একটি কারণে বয়কট আন্দোলনে সে ভাবে যুক্ত হতে পারেনি সেটি হল বিলিতি পণ্য স্বদেশী পণ্যের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম দামী। বয়কট আন্দোলনের সাফল্যের অন্যতম শর্ত ছিল ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা, যা একটা পর্ব থেকে আর পাওয়া যায়নি। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ পণ্য বয়কটে অস্বীকার করেছিল।

নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের ব্যর্থতা থেকে জন্ম নিয়েছিল বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ। ইংরেজ শাসক ও তার সহযোগীদের হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মাধ্যমে খতম করাই ছিল এই ধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কলকাতায় অনুশীলন সমিতি বারীন ঘোষ ও ভূপেন দত্তের নেতৃত্বে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। হেমচন্দ্র কানুনগো মানিকতলায় বোমার কারখানা তৈরি করেছিলেন। ১৯০৮ সালে ৩০ শে এপ্রিল শ্বেতাঙ্গ বিচারপতি কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ব্যর্থ হয়েছিল। পূর্ববঙ্গে পুলিনবিহারী দাসের নেতৃত্বে ঢাকা অনুশীলন সমিতি বেশ কয়েকটি বড়ো ডাকাতি করেছিল।

স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সাংস্কৃতিক জাগরণ। সুমিত সরকার তাঁর  The Swadeshi Movement in Bengal গ্রন্থে এ বিষয়ে বিষদ আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত সেন, মুকুন্দ দাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখের গান জাতীয়তাবাদের প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল। স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শের সঙ্গে সংগতি রেখে বহু লোকসংগীত বাঁধা হয়েছিল। এই সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের ঠাকুরমার ঝুলি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসু শিল্পকলায় প্রাচীনের পুনরুদ্ধারের রত হয়েছিলেন। বিজ্ঞান গবেষণায় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।

স্বদেশী আন্দোলনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল শ্রমিকশ্রেণীর অংশগ্রহণ। শ্বেতাঙ্গ মালিক ও কর্মচারীদের বর্ণবৈষম্যের স্বীকার শ্রমিক শ্রেণী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন অশ্বিনী কুমার বন্দোপাধ্যায়, প্রভাত কুসুম রায়, অপূর্ব কুমার বোস প্রমুখ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...