সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন | Non-Aligned Movement (NAM)

জোট নিরপেক্ষ নীতি 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন-- এই দুই পরাশক্তির আবির্ভাব ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদের ছত্রতলে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্যবাদের ছত্রতলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে পরস্পর বিরোধী জোট গঠনে অগ্রসর হয়। দ্বিমেরুতার এই রাজনীতি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও গ্রাস করতে উদ্যত হয়। এই প্রেক্ষিতে জোট রাজনীতিকে অস্বীকার করে নির্জোট আন্দোলনের (NAM) সূচনা হয়। নির্জোট আন্দোলনের রূপকার ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ, মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের, ঘানার রাষ্ট্রপ্রধান নত্রুমা এবং পরবর্তীকালে যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটো, যিনি স্ট্যালিন কর্তৃক কমিনফর্ম থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন। 

জোট নিরপেক্ষতার প্রধান যুক্তি ছিল, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলির সামনে যে একাধিক সমস্যা রয়েছে তার সমাধান সম্ভব একমাত্র স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে, জোট রাজনীতির আবর্তে পড়লে এই সমস্যা আরো জটিলতর হবে। অর্থাৎ সাম্যবাদী এবং পুঁজিবাদী জোট থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে উভয় বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন ও বজায় এই নীতির অন্যতম দিক ছিল। অনেক পশ্চিমী ভাষ্যকার নির্জোট আন্দোলন বলতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিষ্ক্রিয়তা বুঝেছেন। তবে জোট নিরপেক্ষ দেশসমূহ নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়নি। নেহেরু বলেছিলেন, জোট নিরপেক্ষতার অর্থ নির্লিপ্ততা নয়, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনে যুদ্ধবাদী অশুভ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা। বস্তুতপক্ষে জোট নিরপেক্ষতা হল স্বেচ্ছায় দুই বৃহৎ শক্তিজোটের বাইরে থেকে বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি সচেতনভাবে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করা। এভাবেই জোট নিরপেক্ষতা আন্তর্জাতিক বিশ্বে একটি নতুন মঞ্চ গড়ে তুলেছিল।

নির্জোট আন্দোলনের প্রথম প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছিল ১৯৪৭ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এফ্রো-এশিয়ান দেশগুলির সম্মেলনে। তারপর ১৯৪৯-এ নেহরুর উদ্যোগে দিল্লিতে আরো একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোকে নিয়ে, যেখানে একটি মঞ্চ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। এরপর ১৯৫৪ সালে কলম্বোতে জোট নিরপেক্ষতা সংক্রান্ত প্রথম প্রস্তাব ওঠে। তবে নির্জোট আন্দোলনের প্রকৃত যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় বান্দুং সম্মেলনে, যেখানে ২৭ টি এফ্রো-এশিয়ান দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন এবং তাড়া ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সমর্থন জানান। ১৯৬১ সালে যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেডে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কয়েকটি সাধারণ নীতি ঘোষিত হয়। এগুলি হলঃ

১. জোট নিরপেক্ষ দেশগুলি স্বাধীন বিদেশনীতি গ্রহন করবে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান

২. অন্যের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হবে না

৩. রাষ্ট্রগুলি প্রত্যেকটি জাতির স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি নিরন্তর সমর্থন জানাবে 

৪. বৃহৎ শক্তির সংঘাতের ফলে সৃষ্ট কোন সামরিক জোটের সদস্য হওয়া যাবে না 

৫. যদি দুই বৃহৎ শক্তির কোনটির সাথে দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তি করতে হয় বা জোটের অন্তর্ভুক্ত হতে হয় অথবা ঐ শক্তিকে নিজের দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ দেয় তাহলে যেন তা কখনোই দুই বৃহৎ শক্তির সংঘাতের প্রেক্ষিতে সৃষ্টি না হয়।


উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির মঞ্চ হিসাবে নির্জোট আন্দোলন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দুই সুপার পাওয়ারের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করা, আঞ্চলিক সংঘর্ষের অবসান ঘটান্‌ রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রয়াসক সমর্থন জানানো এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদ এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রতি জনমত গঠনে নির্জোট আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া নয়া উপনিবেশবাদী শোষনের বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করেছে এবং আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধ, আফগানিস্তানের সংকট ইত্যাদি আঞ্চলিক সংঘাত নিরশনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রশ্ন উঠেছে যে, ঠান্ডা লড়াই যখন রইল না তখন জোট নিরপেক্ষতার প্রাসঙ্গিকতা কি? এর উত্তরে বলা যায়, ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান ঘটলেও বৃহৎ শক্তি কর্তৃক অপেক্ষাকৃত ছোট রাষ্ট্রের উপর শোষণ কি বন্ধ হয়েছে। আমেরিকার তেল কূটনীতি, ঋণের ফাঁদ এবং বিশ্বায়ন ও মুক্ত অর্থনীতির নামে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ বরং আগের থেকে তীব্র আকার ধারণ করেছে। তার দোষর রাষ্ট্রগুলিও সেই পথেই হাঁটছে। এমনকি কমিউনিষ্ট চিন সম্পর্কেও এই অভিযোগ ওঠে। উপরোক্ত শোষণমূলক কর্মসূচির প্রতিবাদে NAM সর্বদাই দৃপ্তকণ্ঠ ছিল এবং আছে। এজন্যই জোট নিরপেক্ষতা তখনও প্রাসঙ্গিক ছিল, আজও আছে। তাই দিনের-পর-দিন এর সদস্য সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক