মুঘল- শিখ সম্পর্ক
শিখ ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন গুরু নানক। পঞ্চদশ শতকে তারই হাত ধরে একটি পৃথক ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে শিখদের আবির্ভাব ঘটে। এই ধর্মের উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল কুসংস্কার ও জাতিভেদের বিরোধিতা করা এবং ধর্মের দরজা হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করা।
শিখদের প্রথম গুরু ছিলেন নানক। নানকের মৃত্যুর পর গুরু পদে অধিষ্ঠিত হন গুরু অঙ্গদ। গুরু অঙ্গদ থেকে গুরু অর্জুন পর্যন্ত মুঘলদের সঙ্গে শিখদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। গুরু রামদাসের সময় মুঘল সম্রাট আকবর পাঁচ বিঘা জমি দান করেছিলেন, সেখানে অমৃতসর নামে একটি পুকুর খনন করে পুকুর সংলগ্ন এলাকায় হরিমন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। ক্রমশ এই মন্দির এবং অমৃতসর হয়ে ওঠেছিল শিখ সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক উপাসনার কেন্দ্র। গুরু রামদাসের অনুরোধে আকবর পাঞ্জাবে এক বছরের রাজস্বও মুকুব করে দিয়েছিলেন।
জাহাঙ্গীরের পারিবারিক দ্বন্দ্বে গুরু অর্জুনের নাক গলানোর ফলে মুঘলদের সঙ্গে শিখদের এতদিন যে শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক ছিল তাতে ফাটল ধরে। জাহাঙ্গীরের পুত্র খসরু বিদ্রোহ করলে গুরু অর্জুন তাকে সহযোগিতা ও আশ্রয় প্রদান করেন। এই অপরাধে জাহাঙ্গীর তার উপর জরিমানা ধার্য করেন। গুরু তা দিতে অস্বীকার করলে তাকে বন্দী করা হয়। বন্দি অবস্থায় লাহোরে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো সংঘর্ষ বাধে নি।
গুরু অর্জুনের মৃত্যুর পর গুরু হরগোবিন্দ (১৬০৬-৪৫) পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শিখদের সামরিকীকরণ করার চেষ্টা করেন। তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে যোগদান করার জন্য পাঠানদের কাছেও আবেদন করেন। গুরুর কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে জাহাঙ্গীর গুরুকে বন্দী করেন। শান্তি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গুরু মুক্তি পান। কিন্তু আবার বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং আত্মরক্ষার জন্য পার্বত্য এলাকায় পলায়ন করেন।
হরগোবিন্দ-এর মৃত্যুর পর গুরু পদে অধিষ্ঠিত হন গুরু হররায় (১৬৪৫-৬১)। শাহজাহানের সঙ্গে গুরুর সুসম্পর্ক ছিল কিন্তু উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে তিনি দারার পক্ষ অবলম্বন করে ঔরঙ্গজেবের বিরাগভাজন হন। এই অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
গুরু হররায়ের মৃত্যুর পর গুরু পদে অধিষ্ঠিত হন গুরু হারকিষণ। তাঁর সময়কালে তেমন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেনি। মুঘলদের সঙ্গে কোন সংঘাতের পরিচয়ও পাওয়া যায় না। দিল্লিতে থাকাকালীন তিনি বসন্ত রোগে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর গুরুপদ নিয়ে শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ শুরু হয় এবং গুরু নির্বাচনের দায়িত্ব ওরঙ্গজেবের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওরঙ্গজেব শিখদের ধর্মীয় ব্যাপারে আর মাথা গলাতে চাননি। শেষ পর্যন্ত হরগোবিন্দ-এর দ্বিতীয় পুত্র তেগবাহাদুর গুরু পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন শিখদের নবম গুরু।
তেগ বাহাদুরের সঙ্গে প্রথমদকে ওরঙ্গজেবের সুসম্পর্ক ছিল। তিনি রামসিংহের সঙ্গে আসাম অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আনন্দপুর ছিল তার আস্তানা। বিভিন্ন কারণে ওরঙ্গজেব এর সঙ্গে তেগ বাহাদুর এর সম্পর্ক খারাপ হয়। বলা হয় যে তেগবাহাদুর সাচ্চা বাদশাহ পদবী গ্রহণ করেছিলেন এবং কাশ্মীরের হিন্দুদের ওরঙ্গজেব এর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছিলেন আর তাতেই ঔরঙ্গজেব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। ওরঙ্গজেব বাহাদুরকে বন্দি করে দিল্লি নিয়ে আসেন। তার সেখানেই মৃত্যু হয়। তেগ বাহাদুর এর মৃত্যুর ঘটনা মুঘল সুসম্পর্কের দীর্ঘদিনের ইতিহাসের পাকাপাকি ছেদ ঘটায়।
তেগবাহাদুরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গুরু গোবিন্দ সিংহ (দশম এবং শেষ ধর্মগুরু) তাঁর অনুগামীদের মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। তিনি তাদের যুদ্ধকৌশল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পাঠানদের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং আনন্দপুরকে মোগলদের বিরুদ্ধে সদর দপ্তরে পরিণত করেন। ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে গোবিন্দ সিংহ খালসা বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। ঘোষণা করা হয় এখন থেকে খালসা-ই হবে শিখ সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব। এইভাবে নানকের শিষ্যরা সৈনিক-সন্ন্যাসীতে পরিণত হল। শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সাধনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেকটি শিখ কে পঞ্চ 'ক' অর্থাৎ কাচ্ছা, কড়া, কৃপাণ, কঙ্গা এবং কেশ ধারণ করার নির্দেশ দেওয়া হল। এ প্রসঙ্গে সতীশচন্দ্র বলেছেন যে, সব রকম অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ থাকলেও গুরু গোবিন্দ সিংহের আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল গুরু শাসিত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
গুরু গোবিন্দের কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে ওরঙ্গজেব গুরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার নির্দেশ দেন। মুঘল সেনা আনন্দপুর অবরোধ করে। শিখরা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। গুরু কোনোক্রমে চমকোরে পলায়ন করতে সক্ষম হন। মুঘলরা চমকোর আক্রমণ করলে গুরু মাছিবার জঙ্গলে আশ্রয় নেন। এখান থেকেই তিনি ঔরঙ্গজেবকে বিখ্যাত 'জাফরনামা' পত্রখানি রচনা করেন। ১৭০৬ সালে তিনি খিদরামের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাতিয়ালা রাজ্যে আশ্রয় নেন এবং নতুন করে খালসা বাহিনী গঠন করেন। অতঃপর ওরঙ্গজেব গোবিন্দ সিংহকে দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। গোবিন্দ সিংহ সাক্ষাতের জন্য দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু সংবাদ পান। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তিনি দরবারে গৃহযুদ্ধে মোয়াজ্জেমের পক্ষ অবলম্বন করেন। মোয়াজ্জেমের সাফল্যলাভের ফলে তিনি সম্রাটের কাছে যথেষ্ট সম্মান লাভ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বান্দা নামে এক ব্যক্তি নিজেকে গুরু দাবী করে শিখদের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। তাঁর মৃত্যুর পর শিখরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন এবং রঞ্জিত সিংহ পর্যন্ত এই ধারা চলে।
মুঘল যুগের সিখদের বিদ্রোহকে অনেক ঐতিহাসিক ধর্মনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। শিখ বিদ্রোহ সঙ্গে কতটা ধর্ম দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল তা বলা মুশকিল কারণ যদি তাই হত তাহলে তেগবাহাদুরের মৃত্যুর পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যেত। গুরু গোবিন্দ সিংহকে ওরঙ্গজেব কখনোই দরবারে আমন্ত্রণ করতেন না বা পাঠানরা তাদের পক্ষ অবলম্বন করত না। আসলে মধ্যযুগের অন্যান্য লড়াই গুলির মতই শিখ বিদ্রোহ ছিল রাজনৈতিক লড়াই তথা জমি দখলের লড়াই। সতীশচন্দ্র লিখেছেন শিখ বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে নিম্নশ্রেণির আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তবে তাদের কোনো সুস্পষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। খুব বড়জোর তারা একটা কৃষিভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল মাত্র।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন