সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুঘল ভারতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা | Mughal Banking System

মুঘল ভারতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা

মুঘল ভারতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, Mughal Banking System
মুঘল যুগে ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিল কৃষি। কিন্তু কারিগরি উৎপাদন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে আলোচ্য পর্বে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল। অভ্যন্তরীণ এবং সামুদ্রিক বাণিজ্য বিস্তার লাভ করেছিল। কারিগরি উৎপাদন ও বাণিজ্যের ওপর ভর করে দ্রুতগতিতে নগরায়ন হয়েছিল। বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধান সহায়ক হয়ে উঠেছিল এই যুগের উন্নত ব্যাংকিং ব্যবস্থা।

গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট ব্যাংকারদের উপস্থিতি ছিল। 'শরফ' নামে পরিচিত এক প্রকার ব্যাংকাররা কৃষক এবং কারিগরদের ঋণ দিতেন। অনেক সময় বণিকরা কৃষকদের ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য ঋণ প্রদান করতেন। রাষ্ট্রের তরফ থেকে কৃষকরা 'তাকাভি' নামক এক প্রকার ঋণ পেত। ট্যাভার্নিয়ের রচনা থেকে জানা যায় প্রতিটি গ্রামে একজন করে মহাজন থাকতেন যারা এই ঋণ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন। 

ব্যাংক এবং বীমা ব্যবস্থা পরিচালিত হত 'শরফ'দের মাধ্যমে। লেটার অফ এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে এরা দূরে টাকা পাঠাবার ব্যবস্থা করতেন। ট্যাভার্নিয়ের রচনা থেকে জানা যায় এরা এক্সচেঞ্জ এর ক্ষেত্রে বাটা আদায় করতেন। পুরাতন মুদ্রাকে নতুন মুদ্রায় বদলে দিলেও এরা বাটা আদায় করতেন। এদের কাছে সুদের বিনিময়ে টাকা আমানত রাখা যেত এবং স্বল্পমেয়াদে ঋণও নেওয়া যেত। তবে সুদের হার ছিল চড়া। সমকালীন রচনা থেকে জানা গেছে যে একাধিক পেশার সঙ্গে যুক্ত ধনবান ব্যক্তিগণ ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন, যেমন বানিয়া ও মহাজন, ট্যাঁকসালের কর্মী, এমনকি নীল ব্যবসায়ীরাও টাকা ধার দেওয়া বা আমানত রাখার মত কাজ করতেন।

ব্যাংকিং ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল 'হুন্ডি', যাকে ফারসি ভাষায় 'সুরফা' বলা হয়। হুন্ডি হল একপ্রকার প্রতিশ্রুতিপত্র, যা আজকের দিনের চেক বা ব্যাংক ড্রাফটের সঙ্গে তুলনীয়। ব্যাংকারের কাছে গচ্ছিত টাকার বিনিময়ে হুন্ডির মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা পাঠাতে পারত। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে প্রসেসিং ফি হিসাবে বাটা নেওয়া হত। বাটার হার নির্ভর করত দুরত্বের উপর। যেমন সুরাটের হুন্ডি আহমেদাবাদে ভাঙাতে হলে এক থেকে দেড় শতাংশ বাটা দিতে হত। আবার ভারতের বাইরে বাটার হার অনেক বেশি হত; যেমন মোখা বা বসরায় এই হার ছিল ২২-২৪ শতাংশ। 

মুঘল ভারতে চার প্রকার হুন্ডি চালু ছিল। এক, দর্শনী হুন্ডি। এটি আজকের দিনের ডিমান্ড ড্রাফট এর অনুরুপ। দুই, মিতি হুন্ডি। এই হুন্ডি জারি করার পর টাকা পেতে কিছু দিন সময় লাগত। তিন, শা-জগ হুন্ডি। এই হুন্ডিতে প্রাপকের নাম লেখা থাকত না। চার, জোখামি হুন্ডি। এই হুন্ডি কম দূরত্বের মধ্যে লেনদেনে ব্যবহৃত হত। এই হুন্ডিতে প্রাপক তৎক্ষণাৎ টাকা পেয়ে যেতেন তাই ঝুঁকির জন্য এক্ষেত্রে বাটা অনেক বেশী হত। 

মুঘল আমলে বীমা-র প্রচলন ছিল। শরফ রা পন্য পরিবহনের সময়ে পন্যের বীমা করাতেন। সেযুগে বীমার খরচ খুব বেশী ছিল না। পন্যের মূল্যের ১ শতাংশ। তবে পরিবহনের দূরত্ব বেশী হলে এই হার বাড়ত। সুজন রাই ভাণ্ডারীর রচনা থেকে জানা যায় বীমার প্রচলন থাকার ফলে বনিকদের ঝুঁকি অনেক কমেছিল। ১৬৬২ সালের ইংরেজ বণিকদের কাগজপত্রে তাদের এই বীমার ব্যবহারে প্রমান রয়েছে। 

পরিশেষে ব্যঙ্ক ও বীমার ব্যবসা ছিল অত্যন্ত লাভজনক। এদের দেওয়া ঋনের উপর শুধু ব্যবসায়ীরা নয় সরকারও অনেক সময় নির্ভর করতেন। ব্যঙ্কাররা এত অর্থ উপার্জন করেছিল যে এরা একটা সময় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিল। যেমন বাংলার বিখ্যাত ব্যঙ্কার জগৎ শেঠ ছিলেন পলাশীর ষড়যন্ত্রের মুল চালক।  


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক