সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

এ. কে. ফজলুল হক ও কৃষক প্রজা পার্টি | A. K. Fazlul Haque and K.P.P.

 এ. কে. ফজলুল হক ও কৃষক প্রজা পার্টি


দেশভাগ ও স্বাধীনতার সমসাময়িককালে এবং তার কিছু আগে ও পরে বাংলার রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন এ কে ফজলুল হক। 'শেরে বাংলা' নামে পরিচিত ফজলুল হক তার প্রাথমিক জীবনী পেশায় একজন আইন ব্যবসায়ী ছিলেন। পরবর্তীকালে সালিমুল্লাহ ও নবাব আলী চৌধুরীর সান্নিধ্যে এসে তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতিতে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য তিনি ক্রমশ মুসলমান শিক্ষিত সমাজের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি নামে একটি আধা রাজনৈতিক সংগঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই মতানৈক্যজনিত কারণে তিনি দলবল নিয়ে ১৯৩৫ সালে কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেন। এই দল হকের নেতৃত্বে কৃষকদের অধিকার পুনরুদ্ধার ও জমিদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের মুক্তিদান এবং জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে তাদের জমির মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আন্দোলন শুরু করেছিল। এর ফলে কৃষক প্রজা পার্টি কৃষিজীবী নিম্নবৃত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি মহম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে বিভিন্ন কারণে তার মতপার্থক্য ছিল। জিন্নাহর সাম্প্রদায়িক প্রচার নীতি ফজলুল হক মেনে নিতে পারেননি। ফজলুল হকের চেষ্টাতেই বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীকে মুসলিম লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা সম্ভব হয়েছিল। তাই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছিল। নির্বাচনে কংগ্রেস প্রথম স্থান অধিকার করলেও এককভাবে সরকার গঠন করার মতো জায়গায় ছিল না। অন্যদিকে মুসলিম লীগ দ্বিতীয় এবং কৃষক প্রজা পার্টি তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। তাই শেষ পর্যন্ত ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে যৌথভাবে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। ফজলুল হক বাংলা সরকারের মুখ্যমন্ত্রী রূপে অধিষ্ঠিত হন। শিক্ষাদপ্তর তাঁর হাতেই থাকে। তাঁকে ছাড়া মন্ত্রীসভার ১০ সদস্যের মধ্যে ৫ জন হিন্দু ও ৫ জন মুসলমান মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই কোয়ালিশনে দলগত বিতর্ক ও কলহ শুরু হয় এবং অনেকেই দলত্যাগ করেন। সমস্যাবলি সত্ত্বেও কৃষক প্রজা পার্টি জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, সকল দমনমূলক আইন বাতিল এবং সকল রাজবন্দি ও বিনা বিচারে আটক ব্যক্তিদের মুক্তিসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ব্রিটিশ চাপ দিয়েছিল।

কিছুদিন পর নাটকীয়ভাবে ফজলুল হক কর্তৃক নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গের অজুহাতে প্রজা পার্টির প্রগতিবাদী ২১ জন সদস্য কোয়ালিশন ত্যাগ করেন। ফলে লীগ সুবিধা পেয়ে যায়, কারন আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সমর্থনের জন্য হক লীগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হক কিছু যুক্তিসঙ্গত শর্তে জোট গঠনের প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেসের দ্বারস্থ হন। কিন্তু কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখাত হলে হক মুসলিম লীগের উপর আরও বেশি নিরভরশীল হয়ে পড়েন। ১৯৩৭ সালের ১৫ অক্টোবর লক্ষ্ণৌতে হক আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগের মতবাদ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলার কোয়ালিশনের সকল মুসলিম সদস্যকে লীগে যোগদানের এবং লীগের পতাকাতলে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। পুরষ্কার হিসাবে তাঁকে লীগের লাহোর অধিবেশনের (১৯৪০) সভাপতি করা হয়। এদিকে একের পর এক দলত্যাগ, সমর্থন প্রত্যাহার এবং বিরোধী দলের অনাস্থা প্রস্তাবের ফলে কোয়ালিশন সরকার ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। কে পি পি তার গুরুত্ত্ব হারাতে থাকে। 

১৯৪১ সালের জুলাই মাসে জিন্নাহর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফজলুল হক ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করলে জিন্নাহ্ তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে এবং কোয়ালিশন দল থেকে লীগকে প্রত্যাহার করেন। এই পরিস্থিতি অবশ্য হককে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে নতুনভাবে রাজনৈতিক মৈত্রী গঠনের এক অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছিল। ১৯৪১ সালের ২ ডিসেম্বর হক পদত্যাগ করেন, তবে তিনি কৃষক প্রজা পার্টির প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ, কংগ্রেসের বসু গ্রুপ সহ অধিকাংশ হিন্দু সদস্য এবং হিন্দু মহাসভার রক্ষণশীল সংস্কারবাদীদের নিয়ে একটি প্রগতিশীল কোয়ালিশন গঠন করতে সক্ষম হন। গভর্নরের লীগ-প্রধান একটি মন্ত্রিসভাকে অধিষ্ঠিত করার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পরই শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা রূপে পরিচিত এ নতুন মন্ত্রিসভা ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নর স্যার জন হার্বাটের চক্রান্তে প্রগতিশীল কোয়ালিশনের কর্মসূচি বানচাল হয়ে যায়। ১৯৪৩ এর মার্চ মাসে এই মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেওয়া হয়।

১৯৪৩ থেকে ৪৬ এর মধ্যে লীগ বাংলায় নিজেকে এমনভাবে গুছিয়ে নেয় যে ১৯৪৬ এর নির্বাচনে তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। কে পি পি বাংলার রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তবুও হকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তখনো ছিল। তাই ১৯৪৬ নির্বাচনে কে পি পি যে চারটি আসনে জয়লাভ করেছিল তার ২ টি আসনেই প্রার্থী ছিলেন স্বয়ং হক। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক