সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিনাত্য নীতি | Decan Policy of Aurangazeb

ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিনাত্য নীতি

ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিনাত্য নীতি, Decan Policy of Aurangazeb
ঔরঙ্গজেব তাঁর শাসনের প্রথম দিকে বেশিরভাগ সময় উত্তর ভারতীয় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য দক্ষিণ ভারতের দিকে বিশেষ নজর দিতে পারেননি। এই অবসরে দক্ষিণ ভারতে একটি জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের দুটি স্বাধীন রাজ্য বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। এই সুযোগে মারাঠা জাতি শিবাজীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং মুঘল বিরোধিতার নজির স্থাপন করেছিল। ইতিমধ্যে শাহজাদা আকবর বিদ্রোহ করেছিলেন এবং শিবাজীর পুত্র শম্ভূজীর দরবারে গিয়ে আশ্রয় নেন। এই পরিস্থিতিতে আওরঙ্গজেব মূলত দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে; প্রথমত বিজাপুর ও গোলকুণ্ডাকে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা এবং নবউত্থিত মরাঠা শক্তির বিলোপসাধনের জন্য দাক্ষিণাত্য অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন।

১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট স্বয়ং দাক্ষিণাত্য আসেন।আহম্মদনগর থেকে অভিযান পরিচালনা করার ব্যবস্থা হয়। ইতিমধ্যে শিবাজীর মৃত্যু ঘটে। কিন্তু শম্ভূজীর নেতৃত্বে মারাঠারা তখনও বেশ শক্তিশালী। পরপর চারটি অভিযানে আওরঙ্গজেব মারাঠাদের কতগুলি দুর্গ দখল ছাড়া কিছুই করতে পারিনি বা শাহজাদা আকবরকেও ধরা যায়নি। ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে শম্ভূজী ঔরঙ্গজেবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে শাহজাদা আকবর অত্যন্ত হতাশ হন এবং তিনি পারস্য পলায়ন করেন। অতঃপর বিজাপুর, গোলকুণ্ডা ও মারাঠা মুঘল বাহীনিকে আটকানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়।

শাহজাদা আজমের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী আক্রমণ করে। গোলকুণ্ডা ও মারাঠাদের সাহায্য নিয়ে বিজাপুর প্রায় ১৮ মাস যুদ্ধ চালিয়ে যায়। অবশেষে ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুর আত্মসমর্পণ করে। বিজাপুরকে সাহায্য করার অভিযোগে গোলকুণ্ডা অভিযান চালানো হয় এবং দীর্ঘ ৮ মাসের অবরোধের পর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ২১ ফেব্রুয়ারি গোলকুণ্ডা আত্মসমর্পণ করে। বিজাপুর ও গোলকুণ্ডাকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এরপর মুঘলরা শম্ভূজীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে ওরঙ্গজেব শম্ভূজীকে বন্দী করেন। তার পুত্র সাহুকে বন্দি করা হয়। তবে সম্রাট সাহুকেই মারাঠা রাজ্যের জাগির দিতে চেয়েছিলেন। এরপর শম্ভূজীর ভাই রাজারাম মারাঠাদের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। মুঘল বাহিনী রায়গড় দুর্গ দখল করলে রাজারাম জিঞ্জিতে পলায়ন করে। তারপর তার স্ত্রী তারাবাঈ মারাঠাদের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়।

ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি আপাতদৃষ্টিতে সফল হয়েছিল। বিজাপুর ও গোলকুণ্ডাকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে মারাঠাদেরকে দমন করে তিনি সর্বপ্রথম দাক্ষিণাত্যসহ আসমুদ্রহিমাচল সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন। তাঁরই হাত ধরে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্র প্রথম পূর্ণতা পেয়েছিল। কিন্তু আপাত সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে ছিল সাম্রাজ্যের পতনের বীজ। প্রথমত, দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘ ২৫ বছর অবস্থান করার ফলে ওরঙ্গজেব উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বিশেষ নজর দিতে পারেননি। তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে আঞ্চলিক জমিদার এবং সামন্তরা রাজক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মুঘল দরবারে দল ও রাজনীতি গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে জায়গিরদারী সংকট ঘনীভূত হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে বিদ্রোহীদের নিজ বশে আনার জন্য তিনি উদারহস্তে ব্যাপক পরিমাণে মনসব বিলি করেছিলেন। কিন্তু সেই অনুপাতে বন্টনযোগ্য জমি ছিলনা। ফলে একদিকে জাগীরদারদের মধ্যে 'জমি' তথা 'ভালো জমি' পাওয়ার জন্য এক প্রকার দলবাজি শুরু হয়ে যায়। প্রত্যেকেই সম্রাটের নেকনজরে এসে সুবিধাজনক জাগির প্রাপ্তির চেষ্টায় রত হয়। অন্যদিকে প্রাপ্ত মনসবের হিসাবে জাগির প্রাপ্তি কম হওয়ায় 'জমা' ও হাসিলের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য তৈরী হয়। ফলে কৃষিসংকট ঘনীভূত হয়। তার ওপর অভিজাত ব্যবস্থায় দক্ষিনী মনসবদারদের অনুপ্রবেশের ফলে খানজাদ্ (মনসবদার সন্তান) দের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ফলে আভিজাততন্ত্রে (যা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভ) দলাদলি তীব্র আকার নেয়, যা সাম্রাজ্যের পতনকে তরান্বিত করে। 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...