বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য
জনবিরোধী শাসক হিসেবে লর্ড কার্জনের এমনিতেই কুখ্যাতি ছিল। কিন্তু তাঁর যে পদক্ষেপটি জনসাধারণের সবচেয়ে বেশি অপ্রিয় হয়েছিল সেটি হল বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলা প্রেসিডেন্সির আয়তন বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই উনিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই বাংলা প্রেসিডেন্সির আয়তন কমানো সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব তোলা হচ্ছিল। একবার আসাম ও সিলেটকে বাংলা থেকে আলাদা করার কথা উঠে। ১৮৯৬-৯৭ সালে আসামের মুখ্য কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড প্রস্তাব দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা ও ময়মনসিংহকে অন্তর্ভুক্ত করে আসামকে সমর্থবান করা হোক। ১৯০৩ সালের মার্চ মাসে বাংলার ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজার বাংলার আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাস' সংক্রান্ত একটি মিনিটে ওয়ার্ডের প্রস্তাবকে উত্থাপন করেন এবং বড়লাট কার্জন প্রস্তাবের সামান্য কাটছাঁট করে বঙ্গভঙ্গ-এ সম্মত হন। স্বরাষ্ট্র সচিব রিজলির একটি চিঠিতে সর্বপ্রথম ১৯০৩ সালে ৩রা ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করা হয়।
অ্যান্ড্রু ফেজার, রিজলি এবং কার্জনের যৌথ উদ্যোগে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। আসাম, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী বিভাগ, পার্বত্য ত্রিপুরা এবং মালদহ নিয়ে গড়ে উঠলো নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসাম। নতুন প্রদেশের মোট ৩১ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মুসলমান এবং ১২ মিলিয়ন হিন্দু। অবশিষ্ট বাংলার ৫৪ মিলিয়ন লোকসংখ্যার মধ্যে ৪২ মিলিয়ন হিন্দু এবং ৯ মিলিয়ন মুসলমান। এভাবে নতুন প্রদেশের বাঙালি হিন্দুরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত হল এবং পুরানো প্রদেশে তারা ভাষাগত সংখ্যালঘুতে পরিণত হল। কারণ তারা হিন্দিভাষী এবং উড়িয়াভাষী দের তুলনায় সংখ্যায় কম ছিল।
বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সরকারপক্ষ বলেছিলেন বাংলার ভার লাঘব করা এবং আসামের উন্নতি ঘটানো হচ্ছে বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য। তাদের যুক্তি ছিল আসামের প্রসার ঘটানো দরকার কারণ তাতে এখানকার উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা আরও বিস্তৃত এবং আরো আকর্ষণীয় কর্মক্ষেত্র পাবে। তাছাড়া আসামের চা, তেল ও কয়লা শিল্পের জন্য একটি বন্দর (চট্টগ্রাম) পাওয়া যাবে। বস্তুত এই শিল্পগুলি ছিল বেশিরভাগই শ্বেতাঙ্গ মালিকানাধীন।
বঙ্গব্যবচ্ছেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য গোপন করা হলেও বিভিন্ন সরকারি মিনিট এবং চিঠিপত্রে তা গোপন রাখা যায়নি। বিজলির একটি মন্তব্যে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, ঐক্যবদ্ধ বাংলা একটি শক্তি; বিভক্ত বাংলা নানা দিকে চলবে। এটাই প্রকৃত সত্য এবং এই পরিকল্পনার অন্যতম গুণ। জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশের এই ষড়যন্ত্রকে সহজেই উপলব্ধি করেছিলেন এবং অভিযোগ করেছিলেন যে হিন্দু-মুসলিম বিরোধকে ইচ্ছা করে উস্কানি দেওয়ার জন্যই এই ব্যবচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ বাংলাকে ভাগ করে দিলে হিন্দু বাঙালিরা যারা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদের প্রধান শক্তি তারা দুই প্রদেশেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে এবং এর ফলে জাতীয়তাবাদের ধার কমে যাবে। পৃথক প্রদেশ গঠনের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে জাতীয়তাবাদ থেকে দূরে সরানো যাবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন