সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনী | Subhas Chandra Basu and Indian National Army (INA)

সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনী


বাংলা তথা ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ দশকের বঙ্গীয় রাজনীতি অসম্ভব ঘটনাবহুল। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অক্ষশক্তিপক্ষীয় জাপানের দ্রুত পূর্ব দিক থেকে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ভারতের ব্রিটিশ সরকার পোড়ামাটির নীতি অনুসরণ করে বাংলার শস্য ও সম্পদ নষ্ট করে দেয়। এই অবস্থায় কংগ্রেস ব্রিটিশের পক্ষে না বিপক্ষে অবস্থান করবে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, এই প্রেক্ষাপটে সুভাষচন্দ্র বসু উপলব্ধি করেন ব্রিটিশ বিতারণের সুবর্ণ সুযোগ এসে গেছে।

কংগ্রেসের মধ্যে বাম মনোভাবাপন্ন হিসাবে পরিচিত সুভাষের বিরোধী শক্তির অভাব ছিল না। আবার তিনি ও নেহেরুই ছিলেন তরুণ কংগ্রেসীদের আইকন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ যখন আন্তর্জাতিক পরিসরে কোণঠাসা তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর আঘাত এনে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টা কতটা সঠিক তা নিয়ে গান্ধীর সঙ্গে সুভাষের মতবিরোধ হয়। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দক্ষিণপন্থীদের চাপে সুভাষকে কংগ্রেস ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। দলত্যাগী সুভাষ সারা ভারত ঘুরে জনমত গঠনের চেষ্টা করে, কিন্তু ১৯৪০ এর ৩রা জুলাই ভারতের প্রতিরক্ষা আইনে সুভাষকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও তাঁকে পরে নিঃশর্তে মুক্ত করা হয়, কিন্তু নজর বন্দি রাখা হয়।

সুভাষের বিশ্বাস ছিল ব্রিটিশের বিপক্ষ শিবির অক্ষশক্তির সহযোগিতা নিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা বাস্তবায়িত করা যেতে পারে,কারণ তার ধারণা ছিল বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি জয়ী হতে চলেছে। ১৯৪১ খ্রী ১৬-১৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে তিনি অন্তর্ধান করেন। কাবুল ও রাশিয়া হয়ে বার্লিনে এসে পৌঁছান। গোয়েবলস ও হিটলারের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। তাদের কাছ থেকে তিনি কোনো আশ্বাস পাননি। আজাদ হিন্দ বেতার কেন্দ্র চালু করার অনুমতি পান। উত্তর আফ্রিকায় ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর বেশী আর কিছু না। 

ইতিমধ্যে জাপান ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাতে শুরু করে। মেজর ফুজিওয়ারাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাঠানো হয় প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। ক্যাপ্টেন মোহন সিং যিনি মালয়-এর জঙ্গলে জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, ফুজিওয়ারার সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি হন যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে একটি ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করার জন্য, যারা জাপানিদের সঙ্গে পাশাপাশি থেকে অভিযান করে ভারতবর্ষকে মুক্ত করবে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সমস্ত ভারতীয় মুক্তিকামীদের প্রতিনিধি হিসাবে ঐক্যবদ্ধ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ গঠিত হয়। এটি ছিল একটি বেসামরিক সংস্থা। জাপানে বসবাসকারী অভিজ্ঞ বাঙালি রাসবিহারী বসুকে এই সংগঠনের কর্ণধার হওয়ার আহ্বান করা হয় এবং তার নেতৃত্বে পুরোদস্তুর সামরিক সংগঠন হিসেবে আই এন এ-র উদ্ভব ঘটে। যদিও জাপানিদের দুমুখো নীতি  আই এন এ কে হতাশ করেছিল। তারা ভারতের স্বাধীনতার কথা বললেও আই এন এ কে শুধুমাত্র উপবাহিনী হিসেবে রেখে দিতে চেয়েছিল।

রাসবিহারী বসুর নেতৃত্ব বিশেষ সাফল্য লাভ না করায় মোহন সিং এর পছন্দমত সুভাষচন্দ্র বসুকে জার্মানি থেকে নিয়ে আসা হয় এবং অবশেষে তারই হাতে আই এন এ-র দায়িত্ব অর্পিত হয়। সেই সময় আই এন এ-র বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০,০০০ এবং এরমধ্যে ঝাসির রানীর নামে একটি নারী বাহিনীও ছিল, যা উল্লেখ করার মতো বিষয়। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে সুভাষ এর নেতৃত্বে স্বাধীন ভারতবর্ষের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়, যাকে জাপানসহ জার্মানি, ইতালি এবং আরো অন্য আটটি দেশের সরকার স্বীকৃতি দেয়। আই এন এ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। আই এন এ-র প্রধান লক্ষ্য ছিল জাপানি বাহিনীর সঙ্গে একসাথে বর্মার ভিতর দিয়ে ইম্ফলে এবং পরে আসামে প্রবেশ করা, যেখানে ভারতীয়রা তাদের মাতৃভূমির মুক্তির লড়াইয়ে জাপানি ও আই এন এর সঙ্গে যোগ দেবে বলে আশা করা হয়।

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে আই এন এ-র ইম্ফল অভিযান ছিল সেই অভিশপ্ত অভিযান, যার বিপর্যয়ের ফলে সুভাষ ও আই এন এর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অনুমান করা হয় বিমান শক্তির অভাব, নির্দেশ দানের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত, রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে বিপর্যয়, মিত্রশক্তির ক্ষমতা এবং শেষপর্যন্ত জাপানিদের পক্ষ থেকে সহযোগিতার অভাব-- সব মিলে আই এন এ-র পরাজয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। তবুও সুভাষের কাছে পিছু হটার কোনো রাস্তা ছিল না, কারণ তাতে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার স্বপ্ন চিরতরে বিলুপ্ত হত। তাই তিনি আশাবাদী থেকেছিলেন, বাহিনীকে উৎসাহিত করেছিলেন, এমনকি (অনেকের মতে) রাশিয়ার সাহায্যে ভারতকে মুক্ত করার চেষ্টাও করেছিলেন। অনেকেই অনুমান করেন যে, রাশিয়া যাওয়ার পথে তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছিল। যদিও অনেকেই তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারটিকে অস্বীকার করেছেন।

সুভাষচন্দ্র বসু এবং আই এন এ-র প্রচেষ্টা আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ বলে মনে হলেও একথা সত্য যে সমস্ত ভারতবাসীকে আই এন এর আত্মবলিদান ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছিল। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেকোন মূল্য প্রদানে ভারতবাসী প্রস্তুত হয়েছিল, যার প্রমাণ পাওয়া যাবে আই এন এ-র বন্দীদের বিচারকে কেন্দ্র করে যখন সমগ্র দেশ সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরনকে অস্বীকার করে উত্তাল হয়ে উঠেছিল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক