সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুঘল যুগে কৃষি প্রযুক্তি | Technology in Mughal Agriculture

মুঘল যুগে কৃষি প্রযুক্তি


বর্তমানের মতো মুঘল আমলেও ভারত ছিল কৃষিনির্ভর দেশ। ৭৫ শতাংশের বেশি মানুষের কৃষির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। মুঘল যুগে কৃষির সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সেচব্যবস্থা ও  প্রযুক্তি বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য।  আবুল ফজল , মানুচি,  সুজন রাই ভান্ডারী প্রমুখের রচনা থেকে সেই যুগে প্রচলিত কৃষি প্রযুক্তি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়।

ভারতীয় লাঙ্গল ইউরোপীয়দের কাছে অজানা ছিল। ফ্রায়ার লিখেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে লাঙলে লোহার বদলে কাঠের ফলা ব্যবহার করা হত, কারণ লোহা ছিল দুর্লভ এবং মাটি ছিল নরম। তবে ইরফান হাবিবের মতে তা একমাত্র উপকূলবর্তী অঞ্চলেই সম্ভব ছিল, কারণ দেশের অভ্যন্তরে শক্ত মাটিতে লোহা অপরিহার্য ছিল।তিনি আরও দেখিয়েছেন, সে সময়ে ভারতে লোহার দর ১৯৯৪ এর দরের তিন গুণের বেশি ছিল না।

বীজ রুয়ে চাষ ভারতের পুরনো রীতি। তুহফাত- ই- পাঞ্জাব গ্রন্থে বলা হয়েছে, মাটি ৮ মাস ধরে চষে ইক্ষু চাষের উপযোগী করতে হত। একে আথমাস বলা হত। নোল টেনে মাটি সমান করতে সোহাগা প্রযুক্তির ব্যবহার হত। দুটি বলদের কাঁধের জোয়াল থেকে দুটি দড়ি এসে একটি তক্তার দু'পাশে যুক্ত হত। হালিক এই তক্তায় দাঁড়িয়ে বলদ তাড়ালে মাটি সমান হতো।

সাধারণত উপমহাদেশের জমির উর্বরা শক্তি যথেষ্ট ভালো ছিল। কৃত্রিমভাবে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করার জন্য হাড়ের গুঁড়ো ও শুকনো বা পচা মাছের গুঁড়ো সার হিসাবে ব্যবহৃত হত। একই জমিতে বছরে দু থেকে তিনবার ফসল ফলানো হত। পর্যায়ক্রমিক শস্য উৎপাদনের ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত। কোন মাটিতে কোন ফসল ভালো হয় তা তাদের অভিজ্ঞতায় ছিল, কোন কোন বিশেষ শস্য জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে তাদের সেই জ্ঞানও ছিল।

 বর্ষাকাল ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে পুকুর, কুয়ো বা খাল কেটে কৃত্রিম সেচের ব্যবস্থা ছিল। কুয়ো থেকে জল তোলার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বিত হত। ঝিলামের পূর্বদিকে লাহোর, দিপালপুর, ও শিরহিন্দে 'আরহ' বা 'রহট'  ব্যবহৃত হত যাকে ইংরেজরা পারসি চক্র বলেছে। সারি সারি মাটির পাত্র একটি চক্রের গায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে জল তোলা হত। এছাড়া এর সাথে পিনড্রাম গিয়ারিং ও চামড়ার বকলস থাকত। এর খরচ এত বেশি ছিল যে সাধারন কৃষকের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। আগ্রার চারধারে এবং আরো পূর্বদিকে জোড়া বলদ দিয়ে চরস বা চামড়ার থলির মাধ্যমে জল তোলার প্রচলন ছিল। ফ্রায়ারের বিবরণ থেকে জানা যায় অগভীর জল থেকে জল তোলার জন্য লিভার সংযুক্ত ঢেঙ্কলির কথা। সমকালীন সাহিত্যে পুকুরের অনেক উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রায় প্রতিটা গ্রামেই পুকুর ছিল, তবে বাংলায় একটু বেশি। চাষিরা এই পুকুরের জল সেচের কাজে লাগত। ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন সেকালে নদীগুলি বারবার গতি পরিবর্তন করত। ফলে বাতিল হওয়া খাতগুলি খালে পরিণত হত, যা সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হতো। কিংবদন্তি অনুসারে পূর্ব যমুনার খালের পুরানো খাতটি শাহজাহানের সময় কাটা হয় । অনিরুদ্ধ রায় মনে করেন এই সমস্ত খাল থেকে বাদশাহ অনেক অর্থ উপার্জন করতেন । দক্ষিনে খাল কাটার রীতি ছিল। বার্নিয়ে আমাদের জানিয়েছেন কৃষিক্ষেত্রে কৃত্তিম নালা ও পারসিক চাকার ব্যবহারও তারা করত।

মুঘল যুগে অন্যান্য আরো কিছু কৃষি প্রযুক্তির নিদর্শন পাওয়া যায় যেমন কোদাল, নিড়ানি , কলম করার সময় গাছ ছিদ্র করার জন্য তুরপুন, ধান ভানানোর কল প্রভৃতি।

কৃষকরা এ সময় নতুন নতুন ফসল ফলাতে উৎসাহী ছিল । পর্তুগিজরা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে তামাক এনেছিল, সতেরো শতকে বাংলায় তুতের চাষ শুরু হয়, এছাড়া মোঘলরা মধ্য এশিয়া থেকে কলম প্রযুক্তি নিয়ে আসে, পর্তুগিজরা দক্ষিণ আমেরিকার আমের সাথে ভারতের আম এর মিশ্রণে আলফানসো তৈরি করেন।

পরিশেষে বলা যায় মুঘল আমলের কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান কৃষি ব্যবস্থার খুব অল্প পার্থক্যই লক্ষ্য করা যায়। সেকালে অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থা এবং কৃষি প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত ছিল।  নিলম চৌধুরী লিখেছেন "in case of the use of seed-drill, the Indians were much ahead of their European counterparts" । জমি উর্বর করার পদ্ধতি, তা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর পদ্ধতি তাদের অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করা যায়। মুঘল আমলে এই আধুনিকতর কৃষি প্রযুক্তি এবং মুঘল শাসকদের সহযোগিতা কৃষির উন্নতির পশ্চাতে প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...