মেইজি সংবিধান
জাপানে মেইজি শাসনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান দেশের জন্য একটি নতুন সংবিধান তৈরী। মেইজি পুনস্থাপনের পর থেকে জাপানে যে নতুন রাজনৈতিক বাতাবরনের সৃষ্টি হয়েছিল তাতে 'স্বাধীনতা ও জনগনের অধিকার সংক্রান্ত আন্দোলন' প্রবল আকার ধারন করেছিল। ব্যপক গণ আন্দোলনের চাপে মেইজি সরকার একটি নতুন সংবিধান প্রবর্তনে রাজি হয়। ইটো হিরোবুমি -র উপর সংবিধান রচনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। ইটো ইউরোপে চলে যান অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। ইউরোপ থেকে ফিরে নতুন সংবিধান প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন। ১৮৮৪ খ্রি ৫টি স্তরবিশিষ্ট একটি নতুন অভিজাত শ্রেণী তৈরি করা হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় এই শ্রেণীর প্রতিনিধিদের নিয়ে ভবিষ্যতে ব্যবস্থাপক সভা গঠিত হবে। ১৮৮৪ খ্রি নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয় যার প্রধান হন ইটো। ১৮৮৮ তে প্রিভি কাউন্সিল তৈরি করা হয় এবং এরও সভাপতি হন ইটো। ১৮৮৯ খ্রি ফেব্রুয়ারি মাসে মেইজি সম্রাট আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন সংবিধান প্রবর্তন করেন। বস্তুত এই সংবিধানের একমাত্র উদ্দেশ্য যাবতীয় কর্তৃত্ব শাসকশ্রেণীর হাতে বজায় রাখা।
নতুন সংবিধানে সম্রাটকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তার দৈব মর্যাদা স্বীকৃত হয়। তিনি সাম্রাজ্যের সমস্ত সামরিক ও অসামরিক কর্মচারি নিয়োগ ও কর্মচ্যুত করতে পারবেন। তাঁকে জাতীয় প্রতিনিধি সভার পরামর্শ সাপেক্ষে আইন প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাঁর অনুমোদন ব্যতীত কোন বিল 'আইন' হবে না। তাছাড়া প্রতিনিধি সভার অধিবেশন কোনো কারণে বন্ধ থাকলে, কোনো অভ্যন্তরীণ সংকট চললে, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সম্রাট জরুরি আইন (Ordinance) জারি করতে পারবেন। প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক দপ্তরের চূড়ান্ত ক্ষমতা তাঁর হাতে থাকল। বিদেশের সাথে সন্ধিস্থাপন বা যুদ্ধ ঘোষণার চরম ক্ষমতা তাঁর হাতে রইল। তিনি স্থল ও নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। পদমর্যাদাসূচক খেতাব প্রদানের অধিকারী হলেন একমাত্র সম্রাট। তিনি আইনগতভাবে বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে, কিন্তু আদালত ও বিচারকদের বিচার করার দায়িত্ব ছিল। তিনি ইচ্ছে করলে অপরাধীকে ক্ষমা করতে বা তার দণ্ড লঘু করতে পারতেন।
নতুন সংবিধান সম্রাটকে বিশেষ কোনো অর্থনৈতিক অধিকার দেয়নি। কর ব্যবস্থার পরিবর্তন, নতুন কর স্থাপন বা রাষ্ট্রের আয় ব্যয় নির্ধারণের ক্ষমতা সম্রাটের ছিলনা, ছিল ডায়েটের এর হাতে। তাছাড়া সংবিধান সংশোধনের অধিকারও সম্রাটের ছিল না; তিনি কেবল প্রস্তাব তুলতে পারতেন। তবে তত্ত্বগতভাবে সম্রাটকে আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের প্রধান করা হয়েছিল।
সংবিধানের ১৮-৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে জনগণের অধিকার এবং কর্তব্যের বিবরণ আছে। অধিকার গুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল - (i) যে কোনো সরকারি বা বেসরকারি পদে এবং স্থল ও জল বাহিনীতে যেকোনো নাগরিক যোগ দিতে পারে। (ii) বেআইনি গ্রেপ্তার, আটক ও শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ হবে। (iii) আইনি অনুমোদন ছাড়া কোনো নাগরিকের বিনা অনুমতিতে তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালানো যাবে না। (iv) সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত হয়। (v) ধর্মাচরণের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। কিন্তু কোনো ধর্মীয় ক্রিয়া-কলাপ যেন অন্যের ধর্মের স্বাধীনতায় না বিঘ্ন ঘটায়। (vi) মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা সম্মিলিত হওয়ার অধিকার স্বীকৃত হয়। কিন্তু অধিকার গুলি দেশের আইন অনুযায়ী সীমাবদ্ধ থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই অধিকারগুলি ছিল সংবিধিবদ্ধ, সংবিধানভিত্তিক নয়; অর্থাৎ যেকোনো অজুহাতে এগুলি নাকচ করতে পারতো (Ordinance জারির মাধ্যমে)। যেমন চীন-জাপান যুদ্ধ ও রুশ-জাপান যুদ্ধ চলাকালীন; কমিনিউস্ট দমনের সময় মেইজি রাষ্ট্র জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার গুলি লঙ্ঘন করেছিল।
সংবিধানের ৩৩-৫৪ নম্বর ধারায় আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী বর্ণিত হয়েছিল। জাতীয় প্রতিনিধিসভা বা ইম্পেরিয়াল ডায়েট ছিল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট - উচ্চকক্ষ বা House of peers এবং নিম্নকক্ষ বা House of Representatives। উচ্চ কক্ষের মোট সদস্য ৩৬৮ জন, যার মধ্যে ২০১ জন অভিজাত শ্রেণীর, ১২২ জন সম্রাটের মনোনীত এবং ৪৫ জন সর্বোচ্চ করদাতাদের প্রতিনিধি। এর থেকে স্পষ্টভাবেই উচ্চ কক্ষের শ্রেণী চরিত্র বোঝা যায়। আর নিম্নকক্ষের সদস্য ছিল ৩৭৯; এরা সবাই জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত। উল্লেখযোগ্য যে, সবাই ভোটাধিকার পায় নি, সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছিল। তাই জনসংখ্যার মাত্র ১% -এর সামান্য বেশি মানুষ ভোট দিতে পারত। এরাই ছিল সক্রিয় নাগরিক, আর বাকিরা নিষ্ক্রিয় নাগরিক। এভাবে মেইজি নেতারা ভোটাধিকার ন্যূনতম ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বিরোধিতা এড়াতে চেয়েছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন