১৮৬৮-১৮৮৯ খ্রীঃ পর্যন্ত জাপানি সংবিধানের জন্য গণআন্দোলন
মেইজি কর্তৃপক্ষের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান ১৮৮৯ খ্রীঃ জাপানের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা, যা সাধারণত মেইজি সংবিধান নামে পরিচিত। শোগুন্তন্ত্রের অবসানের পর মেইজি নেতারা সংসদীয় ধাঁচের একটি সংবিধান রচনার আবশ্যকতা অনুভব করেন এবং সেজন্য আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের দুটি পর্ব ছিল। প্রথমটি ১৮৭৩-৮১ খ্রি. এবং দ্বিতীয়টি ১৮৮২-৮৯ খ্রি.। ঐতিহাসিক ভিনাক বলেছেন, এই সংবিধানের বীজ নিহত ছিল ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের Charter Oath ( সনদভুক্ত শপথপত্র ) এর মধ্যে, যেখানে ঘোষণা করা হয়েছিল দেশের সমস্যাবলী প্রকাশ্যে বিচার-বিবেচনা করার জন্য একটি পরিষদ গঠিত হবে। কিন্তু এই ঘোষণাকে সম্রাট কর্তৃক জনপ্রতিনিধিমূলক সংসদীয় সংবিধান দানের প্রতিশ্রুতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং প্রতিশ্রুতি যাতে কার্যে রূপায়িত হয় তার জন্য আন্দোলন শুরু হয়। অন্যদিকে রক্ষণশীল নেতৃবৃন্দ জনগণের হাতে শাসনক্ষমতা দানের বিরোধী ছিলেন।
প্রকৃত আন্দোলনের সূত্রপাত করেন চোষু সামুরাই 'কিডো', যিনি উদার মনোভাব সম্পন্ন ছিলেন এবং যুরোপ ভ্রমনের অভিজ্ঞতাও তার ছিল। তার বক্তব্য ছিল জনমতকে অগ্রাহ্য করে শাসন পরিচালনা করা অযৌক্তিক এবং অনৈতিক। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতা চলতে পারেনা। দায়িত্বশীল, প্রতিনিধিত্বমুলক শাসনব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে এবং এহেন শাসনব্যবস্থাকে যথাযথ রূপদান করতে পারে এমন একটি সংবিধান তৈরি করতে হবে। এই দাবি নিয়ে তিনি আন্দোলন শুরু করেন।
কিডোর উদারবাদী আন্দোলন ক্রমশ জাপানের সর্বত্র রাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শিক্ষালয়, বক্তৃতামঞ্চ, ক্লাব তথা প্রেসের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে উদারবাদী শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ চলতে থাকে। প্রখ্যাত মেইজি শিক্ষাবিদ ও নেতা ইউকিচি প্রচার করেন, আইনের চোখে সবাই সমান, সবার স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের সমান অধিকার আছে। টোসা সামুরাই ইতাগাকি একটি বিবৃতিতে প্রচার করেন, প্রত্যেক জাপানি জনতার নির্দিষ্ট কতগুলি অধিকার আছে যেমন (যেমন - স্বাধীনতা, সম্পত্তি) সেগুলি প্রকৃতিদত্ত, যা কোনো স্বেচ্ছাচারী সরকার কেড়ে নিতে পারে না। এরপর ইতাগাকি ও আরও কয়েকজন মিলে 'Public Party of Patriots' বা আহিকোকু করে নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করে। এই সংস্থা প্রচার করে, একমাত্র জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত সরকারই স্বীকৃতি লাভের যোগ্য এবং জনস্বার্থ রক্ষা করা ও বজায় রাখা এই সংস্থার উদ্দেশ্য। প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতার নিন্দা করে এরা সরকারের কাছে একটি স্মারকলিপি পাঠায়, তাতে জনগণের পছন্দমত একটি সভা প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়।
এত আন্দোলন সত্বেও জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা দেখা যায়নি। কারণ তারা স্বাধীনতা, সাম্য ইত্যাদি বিষয় বুঝে উঠতে পারেনি। বর্তমান অবস্থাতেই সন্তুষ্ট ছিল। তবুও নেতারা আন্দোলন চালিয়ে যান। ফলে সরকার ১৮৭৪ এ ওসাকা শহরে সভা করে ঘোষণা করে - ভবিষ্যতে একটি নির্বাচিত আইনসভা আহ্বানের প্রস্তুতি হিসাবে একটি সিনেট স্থাপিত হবে। বিচারকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য একটি Highcourt স্থাপিত হবে। রাজ্যপালদের নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে, যা জনগণের ও সরকারের মধ্যবর্তী হিসাবে কাজ করবে।
অন্য নেতারা সন্তুষ্ট হলেও এই ঘোষণায় ইতাগাকি সন্তুষ্ট হযননি, কারণ সিনেট নির্বাচিত না হয়ে মনোনীত হওয়ার কথা ছিল। প্রতিবাদে তিনি সমস্ত সরকারি সরকারি দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৮৭৭-এ প্রতিনিধিমুলক সংবিধান আদায়ের জন্য গণআন্দোলনের পথ ধরেন। ইতিমধ্যে সাইগো তাকামোরির সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রভাবে সশস্ত্র আন্দোলনের সম্ভাবনাও তৈরী হয়। কিন্তু ইতাগাকি ও অন্যান্য মধ্যপন্থীদের বিরোধিতায় তা বাতিল হয় এবং জাতীয় বিধানসভা আহ্বানের দাবি জানিয়ে সরকারকে স্বারক লিপি পেশ করেন। এরপর ওসাকার সর্বদলীয় সন্মেলনে (১৮৮০) ঐ দাবী সম্রাটকে জানিয়ে আবেদন পেশ করা হয়। কিন্তু সম্রাট পর্যন্ত তা গেল না, কারণ প্রথা অনুযায়ী জনগণের সম্রাটের কাছে রাজনৈতিক আবেদন পাঠানোর কোনো অধিকার নেই। এর প্রতিবাদে কাউন্ট ওকুমা পদত্যাগ করেন (১৮৮১)। ঐ বছর সম্রাট ঘোষণা করেন ১৮৯০ খ্রিঃ একটি জাতীয় বিধানসভা প্রতিষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার পর প্রথম পর্বের আন্দোলন শেষ হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন