শাহজাহানের রাজত্বকালে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব
১৬৫৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ৬৫ বছর বয়সে শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাঁর চার পুত্রের মধ্যে চরম সংঘর্ষ শুরু হয়। মুঘল দরবারে সিংহাসন নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব নতুন নয়। উদাহরণস্বরূপ আকবরের বিরুদ্ধে সেলিমের বিদ্রোহ, জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে শাহজাহানের বিদ্রোহ। তবে অন্য সমস্ত দরবারি অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বকে ছাপিয়ে গেছে যে ঘটনা সেটি হল শাহজাহানের রাজত্বকালে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব।
শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন দারাশিকো। দারা শাহজাহানের খুব প্রিয় ছিলেন। পাঞ্জাব, মুলতান ও এলাহাবাদের দায়িত্বে থাকলেও দারা পিতার কাছে থেকেই প্রতিনিধি মারফত শাসন চালাতেন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দারা অনভিজ্ঞ ছিল। কিন্তু জ্ঞান এবং শিক্ষাদীক্ষায় তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ। কিন্তু সিংহাসন লাভের অভিলাসও তার ছিল। শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন সুজা। তিনি দীর্ঘদিন বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন। কোনো গোঁড়ামি বা ভন্ডামি তার ছিল না। কিন্তু তার নৈতিক চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তৃতীয় পূত্র ঔরঙ্গজেব। তিনি একাধারে সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রতিভাসম্পন্ন, কূটনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন, বিদ্বান, সাহসী ও শৃঙ্খলাপরায়ন। তার সরল জীবনযাত্রা, সৌজন্য ও প্রিয়ভাষীতার জন্য তিনি সকলের প্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি কিন্তু শাহজাহানের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। তাই তাকে দীর্ঘ দিন দক্ষিনাত্যতে সুবাদারি দেওয়া হয়েছিল। সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন মুরাদ। তার প্রতিভা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। কিন্তু মদ ও নারীসঙ্গ বিষয়ে তিনি সুজার মত দোষী ছিলেন।
দারা পিতার অসুস্থ্যতার সুযোগ নিয়ে শাসনভার নিজের হতে গ্রহণ করেন এবং তিন ভায়ের আগ্রা আগমনের তিনটি পথ রুদ্ধ করে দেন। এমনকি রাজধানী থেকে কোনো খবর ভাইদের কাছে যাতে পৌঁছাতে না পারে তা নিশ্চিত করেন। দারার সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল ঔরঙ্গজেবকে নিয়ে। তাই আগে থেকেই পিতাকে প্রভাবিত করে ঔরঙ্গজেবকে আগ্রা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যাবস্থা করেন। দক্ষিনাত্যে উত্তর পশ্চিম সীমান্তে এবং মধ্য এশিয়া অভিযানে ঔরঙ্গজেব যাতে সফল না হয় তার চক্রান্ত দারা করেছিল। কারণ তাঁর ভয় ছিল যে ঔরঙ্গজেব সফল হলে দরবারে ও পিতার কাছে তার গুরুত্ব বেড়ে যাবে এবং পিতা শাহাজাহান তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করবে।
ঔরঙ্গজেবের কাছে তার ভগিনী রওসন আরা মারফৎ খবর আসে দারা শাসনভার গ্রহণ করেছে। ঘটনাটি তিন ভাই এর কাছে ক্ষোভের কারণ হয়ে ওঠে। তাদের সকলের অনুমান হয় সম্রাট জীবিত নেই এবং এই খবর দারা ইচ্ছে করে গোপন করেছে। এই প্রেক্ষিতে প্রত্যেকে দারার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত হন। মুরাদ গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। সুজা বাংলার তৎকলিন রাজধানী রাজমহলে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে অগ্রার অভিমুখে রওনা দেন। ঔরঙ্গজেব কিন্তু উপলব্ধি করেন পিতার জীবিতকালে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করলে তিনি জনমত হারাতে পারেন। তাই তিনি সোজা আগ্রা রওনা দেন এবং দীপালপুরে মুরাদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন (১৬৫৮, ২৪শে এপ্রিল)। উভয়ের মধ্যে ঠিক হয় যে দুজনে মিলে সুজা ও দারাকে পরাজিত করে সাম্রাজ্য ভাগ করে নেবেন। প্রসঙ্গত ঔরঙ্গজেব প্রথম থেকেই সিংহাসন দখলের ব্যাপারে অনীহা দেখিয়েছিলেন।
অগত্যা দারা তিন ভাইকে বাধা দেওয়ার ব্যাবস্থা করেন। পুত্র সুলেমান এবং সেনাপতি জয়সিংহকে সুজার বিরুদ্ধে পাঠানো হয়। যোধপুরের যসবন্ত সিংহ এবং কাসিম খানকে মুরাদ ও ঔরঙ্গজেব এর বিরুদ্ধে পাঠানো হয়। সুলেমানের হতে সুজার পরাজয় হয়। অতঃপর সুজা বঙ্গদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এনং আরাকানরাজের হাতে তাঁর হত্যা হয়। ধরমাট ও সামুগড়ের যুদ্ধে ঔরঙ্গজেব ও মুরাদের হাতে দারার পরাজয় হয়। অগত্যা দারা পারস্যে পলায়ন করে। এরপর ঔরঙ্গজেব পিতা শাহজাহানকে নজরবন্দী করেন এবং কৌশলে মুরাদকেও বন্দী করা হয়। পরে তাকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয়। এইভাবে ঔরঙ্গজেব তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভ্রাতাদের পরাজিত করে সিংহাসন দখল করে ২১শে জুলাই তিনি আলমগীর উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন।
Thank you so much Sir.
উত্তরমুছুনস্যার এখন এটা সহজে বুঝতে পারছি।
উত্তরমুছুন