সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নূরজাহান চক্র | Noorjahan Junta

 নূরজাহান চক্র


জগৎ বিখ্যাত প্যারসিক সুন্দরী নূরজাহানের নাম মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মেহেরুন্নেসা তথা নূরজাহানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বিবাহ হয় এবং তিনি বাদশাহের প্রিয়তমা পত্নীতে পরিণত হন। বিবাহের পর থেকে দরবারী কার্যকলাপে নূরজাহানের প্রভাব ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাঁকে কেন্দ্র করে দরবারে একটি চক্র গড়ে ওঠে যা নূরজাহান চক্র নামে পরিচিত। নূরজাহান চক্র সাম্রাজ্যের পক্ষে কতটা লাভজনক বা ক্ষতিকর হয়েছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক বিদ্যমান। 

উচ্চ পদস্থ মুঘল কর্মচারী মির্জা গিয়াস বেগের কন্যা ছিলেন মেহেরুন্নেসা। ১৭ বছর বয়সে বর্ধমানের জায়গীরদার আলী কুলি বেগ ইস্তাজহি- র সাথে তার বিবাহ হয়। আলি কুলি বেগ কেন্দ্রকে নিয়মিত প্রাপ্য দিচ্ছিলেন না। আলি কুলি বেগ বিদ্রোহী ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিলেন এই সংবাদ পেয়ে জাহাঙ্গীর তার বিরুদ্ধে বাহিনী প্রেরণ করেন। উভয় পক্ষের খন্ড যুদ্ধে আলিকুলি বেগের মৃত্য হয়। সম্রাট আলি কুলি বেগের পরিবারের রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব রানী মাতা সেলিমা বেগমের হতে তুলে দেন। এই ঘটনার চার বছর পর মিনাবাজারে জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নেসাকে দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে সম্মতি সহকারে বিবাহ করেন। মেহেরুন্নেসাকে নূরজাহান উপাধিতে ভূষিত করেন। 

সম্রাজ্ঞী হওয়ার পর থেকে জাহাঙ্গীরের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নূরজাহান সাম্রাজ্যের পরিচালিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছিলেন। কেবল রুপ - লাবণ্য নয়, বুদ্ধিমত্তা, দৈহিক শক্তি ও সাহসে তিনি ছিলেন প্রশংসনীয়। জাহাঙ্গীরের প্রতি তার অনুরাগের সীমা ছিল না। এই অনুরাগের জন্যই জাহাঙ্গীর নূরজাহানের হতে প্রায় সমস্ত ক্ষমতা ন্যাস্ত করে দিয়েছিলেন। ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন, জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে নূরজাহান রাজকার্যতে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে সম্রাট প্রায় তার হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন। 

জাহাঙ্গীর নূরজাহানের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন কি না সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে নূরজাহানকে কেন্দ্র করে দরবারে একটি চক্র গড়ে উঠেছিল। মহবৎ খাঁ- র মত বিশ্বস্ত কর্মচারীগণ বঞ্চিত হয়েছিলেন। নুরজাহানের পিতা মির্জা গিয়াস বেগ এবং ভ্রাতা আসফ খান উচ্চপদে উন্নীত হয়েছিলেন। নূরজাহানের আগের পক্ষের কন্যা লাডলির সঙ্গে যুবরাজ শাহরিয়ার বিবাহ হয়েছিল। এইদিকে আসফ খাঁ- র কন্যা মমতাজের সঙ্গে যুবরাজ খুররমের বিবাহ হয়েছিল। 

নূরজাহান চক্র সাম্রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এই পর্বে দলীয় রাজনীতি আরো তীব্র হয়েছিল। নূরজাহান চক্রের সদস্য ব্যাতীত অন্যান্য কর্মচারীদের তেমন পদোন্নতি হয়নি, যেমন অভিজ্ঞ মহব্বত খান।  নুরজাহানের কার্যকলাপের জন্য প্রবীণ কর্মচারী মহবত খাঁ বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। শাহজাদা খুররমকে যখন কান্দাহার অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন তিনি তা পালনে অস্বীকার করেন পাছে বিমাতা নূরজাহান সম্রাটকে দিয়ে শাহরিয়ারকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করিয়ে নেন। তিনি পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এর ফল স্বরূপ কান্দাহার হস্তচ্যুত হয়ে যায়। দরবারে অভিজাতদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ জমতে থাকে। 

তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে জাহাঙ্গীরের মত মদ্যপায়ী শাসকের জীবনে নূরজাহানের মত প্রতিভাবান নারীর অবির্ভাব হয়ে ছিল বলেই তার রাজত্বকালে বিরাট কিছু দুর্ঘটনা ঘটেনি। আর দরবারীর দলীয় রাজনীতি নূরজাহানের সময় নতুন নয়,এই ধারা আকবরের সময় থেকেই চলে আসছিল। এর জন্য যদি কেবল নুরজাহানকে দায়ী করা হয় তবে এই সুন্দরী, প্রতিভাবান পারসিক ললনার প্রতি অবিচার করা হয়।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...