মেইজি শিক্ষা ব্যবস্থা
জাপানে পশ্চিমী সভ্যতাভিত্তিক সমাজ গঠন সার্থক করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থারও সংস্কার দরকার-- মেইজি নেতারা তা সহজেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তারা পশ্চিমি ধাঁচে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজে উদ্যোগী হন। মেইজি শিক্ষা সংস্কারের মূলত তিনটি দিক ছিল। প্রথমত, পশ্চিমী দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসা, দ্বিতীয়ত, জাপানি ছাত্রদের পাশ্চাত্য দেশে শিক্ষার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজানো, যাতে সম্রাট ও রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত এবং দায়িত্বশীল নাগরিক গড়ে তোলা যায়।
পাশ্চাত্য দেশের শিক্ষার্থী পাঠাবার বিষয়টি অবশ্য শোগুন যুগ থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। মেইজি আমলে এই বিষয়টির ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিশিষ্ট মেইজি নেতা যেমন ইটো হিরোবুমি, মারি আরোনারি, ইনোয়ুয়ে প্রমুখ পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার জন্য ইউরোপে পাড়ি দিয়েছিলেন। ঐ একই উদ্দেশ্যে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের জাপানে আমন্ত্রণ করা হয়। ১৮৮৫ খ্রিঃ ইউরোপ থেকে মোট ৩৪ জন খনি বিশেষজ্ঞ আনা হয়েছিল। R.H. Brangton নামে একজন ইংরেজ বিজ্ঞানীকে নৌ শিল্পের উন্নতির উদ্দেশ্যে জাপানে আনা হয়েছিল। বহু জার্মান চিকিৎসককে জাপানে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক E.S Morse জাপানে আসেন এবং তারই তত্ত্বাবধানে জাপানে আধুনিক নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ব, সমাজবিজ্ঞান আলোচনার সূত্রপাত হয়। কিন্তু এই বিশেষজ্ঞ আনায়নের বিষয়টি ছিল অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ, তাই এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বিদেশে ছাত্র পাঠানো এবং পশ্চিমি গ্রন্থের অনুবাদ করার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছিল। একটি সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে মেইজি নেতারা ফ্রান্সের অনুকরণে কেন্দ্রীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে ছিলেন। এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ববোধ ও আনুগত্যবোধকে শক্তিশালী করা।
তানাকা ফুজিমারোর নেতৃত্বে শিক্ষাসংক্রান্ত সংস্কারগুলি রূপায়িত হয়। তার উদ্যোগে ত্রিস্তরীয় শিক্ষা ব্যবস্থা - প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়- গড়ে তোলা হয়। মার্কিন বিশেষজ্ঞ মারে -র সহযোগিতা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল বা শিহান গাক্কো খোলা হয়। ১৮৭৯ খ্রিঃ পাশ্চাত্যের ধাঁচে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। জাপানের শিল্পোন্নতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মমুখী শিক্ষার জন্য একাধিক শিল্প-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়। এগুলি সেম্মন গাক্কো নামে পরিচিত ছিল। নারীশিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যেও মেইজি নেতারা কিছু স্কুল খুলে ছিল, কিন্তু তাদের এই প্রয়াস ছিল আংশিক। ঘরোয়া দায় দায়িত্ব পালনের উপযোগী নারী তৈরিই তাদের লক্ষ্য ছিল।
মেইজি শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল আদতে রক্ষণশীল। কনফুসীয় মতাদর্শের উপর গুরুত্ব আরোপ করে, নাগরিকদের জাতীয়বাদী মূল্যবোধ ও রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্র ও রাজার প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করার দিকে লক্ষ্য রেখেই পাঠক্রম তৈরি হয়েছিল। শিক্ষকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি করার জন্য প্রত্যেক শিক্ষককে সামরিক শিক্ষা নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। রাজানুগত্য ও জাতীয়বাদকে সামনে রেখেই ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে যে শিক্ষানীতি ঘোষিত হয়েছিল তাতে শিক্ষা ব্যবস্থার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত সুদৃর করা হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারি স্কুলগুলিতে ওই রাজকীয় অনুশাসনের একটি অনুলিপি এবং সম্রাটের একটি ছবি রেখে দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। একটি বিশেষ দিনে সম্রাটের ছবি সামনে রেখে বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সেই অনুশাসন ছাত্রদের পড়ে শোনাতেন এবং প্রত্যেক ছাত্রকে সম্রাটের মর্যাদা রক্ষা এবং দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য আত্মনিয়োগে প্রস্তুত থাকার জন্য অঙ্গীকার করতে হতো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন