সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চীন-জাপান যুদ্ধের (১৮৯৪) পটভূমি | Background of Cino-Japan War, 1894

চীন-জাপান যুদ্ধের (১৮৯৪) পটভূমি:

মেইজি শাসকরা জাপানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এই প্রয়াসের পশ্চাতে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল জাপানে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনকে রুদ্ধ করা এবং এই কাজে তারা নিঃসন্দেহে সফল হয়েছিলেন। মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ২০ বছরের মধ্যেই জাপান অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হয়। এই সমৃদ্ধির অনিবার্য ফসল ছিল সাম্রাজ্যবাদের উত্থান। অন্যভাবে বলা যায় জাপানে পুঁজিবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের উন্মেষ ঘটেছিল। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়ার বিরুদ্ধে জাপান সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করেও তা বাতিল করেছিল। কোরিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চীন-জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪) সংঘটিত হয়েছিল।

কোরিয়া অভিযানের পরিকল্পনা বাতিল হওয়ার পর জাপান কোরিয়ার সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মাধ্যমে কোরিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ইঞ্চয়, পুসান ও ওনসান- কোরিয়ার এই তিনটি বন্দর জাপানের বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়। ফলে চীনের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়, কারণ এতদিন করিয়া ছিল চীনের করদ রাজ্য। এই প্রেক্ষিতে চীন-জাপান দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ইতিমধ্যে কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দুটি গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। একটি জপানপন্থী এবং অপরটি চীনপন্থী। চীনপন্থী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন টাঙ্গুন এবং জাপান গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিলেন রানী মিন। চীনপন্থী গোষ্ঠী ১৮৮২ খ্রিঃ জাপানি দূতাবাসে অগ্নিসংযোগ করে এবং এর ফলে সাতজন জাপানি অফিসার মারা যান। প্রতিশোধ নিতে জাপান কোরিয়াতে যুদ্ধজাহাজ পাঠায় তখন চীনের পরামর্শে কোরিয়া জাপানের সঙ্গে একটি চুক্তি করে (চেমুল্ল চুক্তি, ১৮৮২) আপাতত সংকট নিরসনের করে। চুক্তির মাধ্যমে জাপান কোরিয়াতে স্থায়ীভাবে সৈন্য মোতায়েনের অধিকার পায়। চিনে তৎক্ষণাৎ কোরিয়ার সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন করে এবং কোরিয়াতে অতি আঞ্চলিক অধিকার লাভ করে। 

এরপরেও কোরিয়াতে চীনপন্থী ও জাপানপন্থীদের মধ্যে বিরোধ অব্যাহত থাকে। জাপান ক্রমশ তার শিল্পায়নের স্বার্থে কোরিয়ার প্রতি বিশেষ উৎসাহ দেখাতে থাকে। কোরিয়ার চালের উপর জাপান নির্ভরশীল ছিল। কোরিয়া আগত চীনা সেনা প্রশিক্ষক ইউয়ান-শি-কাই-এর প্ররোচনায় কোরিয়া জাপানে চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এই প্রেক্ষিতে জাপানপন্থীরা একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয় এবং ওদের নেতা কিম-ওক-কিউন, যিনি জাপানে আশ্রয় নিয়েছিলেন,  তাকে ষড়যন্ত্র করে সাংহাইতে নিয়ে এসে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পেছনে চীনা রেসিডেন্ট এবং চীনের সামরিক প্রতিক্ষক ইউয়ান-শি-কাই এর বিশেষ ভূমিকা ছিল। এই সমস্ত ঘটনাবলি জাপানকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে।

কিছুদিন পর কোরিয়াতে টংহক অভ্যুত্থান দেখা দেয়। কোরিয়ার রাজদরবার বিদ্রোহ দমনের জন্য চীনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। এই প্রেক্ষিতে জাপানের কূটনীতি লক্ষনীয়। জাপান চেয়েছিল চীনের সামরিক বাহিনী কোরিয়ায় হস্তক্ষেপ করুক। কারণ তার ফলে জাপানের পক্ষেও কোরিয়ায় সৈন্য প্রেরণের রাস্তা খুলে যাবে। জাপান কোরিয়ার বিদ্রোহ দমনে চীনকে মদত করবে বলেও জানিয়ে দেয়। চীন জাপানের ফাঁদে পা দেয়, চীনের সৈন্য প্রেরনের সাথে সাথেই জাপান ৮০০০ সৈনের একটি বাহিনী কোরিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। টাংহক বিদ্রোহ সহজেই দমিত হয়। কিন্তু জাপান তখনও সৈন্য প্রত্যাহার করে না, উপরন্তু কোরিয়া সরকারকে অভ্যন্তরীণ সংস্কার সাধনের জন্য চাপ দিতে থাকে। চিনা রাজপুরুষ লি- হ্যাং-চ্যাং কোরিয়া সরকারকে চাপ দিতে থাকে জাপানের সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের জন্য। 

এই প্রেক্ষিতে চীন ও জাপান উভয় বাহিনী সিওল -এ মুখোমুখি হয়। চীন যুদ্ধ না করে পশ্চিমী শক্তিবর্গ এর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। ব্রিটেন ও আমেরিকার শান্তি বজায় রাখার আবেদন জাপান অগ্রাহ্য করেছিল। ১৮৯৪ -এ জুলাই মাসে জাপানি সৈন্যরা সিওল এর রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ও নিজেদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে। শেষ পর্যন্ত ১লা আগষ্ট উভয়ই উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে চীন জাপান যুদ্ধের সূচনা হয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক