ওয়াশিংটন সম্মেলনের পটভূমি আলোচনা কর। এই সম্মেলন পূর্ব এশিয়ায় জাপানের আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে কতটা সক্ষম হয়েছিল?
এশিয়ার উদীয়মান শক্তির জাপানের ক্ষমতা সীমায়িত করণ এবং পশ্চিমী উপনিবেশবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে জাপানের সমঝোতা স্থাপনের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন সম্মেলন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর থেকে ১৯২২ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন শহরে সমকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের আহ্বানে আমেরিকা, ব্রিটেন ও জাপান সহ মোট নয়টি দেশ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিল। যেখানে বিভিন্ন দেশের মধ্যে মোট সাতটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সম্মেলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের সম্প্রসারণ রোধ করা। কিন্তু তা কতটা সম্ভব হয়েছিল তাতে সন্দেহ আছে।
পটভূমি
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জাপান প্রায় সমগ্র পূর্ব এশিয়াতে একছত্র আধিপত্য স্থাপন করে ফেলেছিল। উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত যাবতীয় সমুদ্র মুখগুলি জাপানের নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। শাখালিন এর অর্ধেক এবং কুরাইল দ্বীপপুঞ্জ নিজের অধিকারে এনে জাপান ওখোটস্ক সাগরে অনুপ্রবেশের রাস্তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল। শাখালিন, হোক্কাইডো ও কোরিয়ার ওপর জাপানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে জাপান সাগরে প্রবেশের রাস্তা পশ্চিমাদের কাছে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। জাপান ইয়েলো সাগরের মুখ পশ্চিমীদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল এবং সাইবেরিয়ায় অনুপ্রবেশের জলপথ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিল। কোরিয়ার ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে তার পক্ষে মাঞ্চুরিয়া দখলের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। চীনের সান্টুং অঞ্চলে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ফলে পিকিং এর রাজদরবার যথেষ্ট সন্ত্রস্ত ছিল। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকা ও ব্রিটেন এর পক্ষে চুপ থাকা সম্ভব হল না।
আমেরিকা ও গ্রেট ব্রিটেন প্রথমদিকে জাপানকে বিশেষ সহযোগিতা দিত ওই অঞ্চলের রাশিয়ার অগ্রগতি রোধ করার জন্য। ১৯০২ এ তাই ইঙ্গ-জাপান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জাপানের আগ্রাসী নীতি ব্রিটেন ও মার্কিন এর পক্ষে অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। মাঞ্চুরিয়াতে মার্কিন পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জাপান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর আমেরিকা ও কানাডায় জাপানি অভিবাসন সমস্যাকে কেন্দ্র করে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। আমেরিকার সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ফলে তাদের মিত্র রাষ্ট্র ব্রিটেন আপনা আপনি জাপান থেকে দূরে সরে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানজনিত ভীতি অল্প কিছুদিনের জন্য জাপানের সঙ্গে আমেরিকার সদ্ভাব তৈরি করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অবশেষে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা দূরপ্রাচ্যে নৌশক্তি প্রশমন এর প্রস্তাব দিয়ে ওয়াশিংটন সম্মেলনের আহ্বান জানায়।
চুক্তি ও তার শর্তসমূহ
ওয়াশিংটন সম্মেলনে স্বাক্ষরিত সাতটি চুক্তির মধ্যে প্রধান তিনটি চুক্তি হল- ১. প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ গুলির উপর একে অপরের অধিকারকে মর্যাদা দেবে। তা সত্ত্বেও যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মেটানো হবে। ব্রিটেন, জাপান ও আমেরিকার মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চতুঃশক্তি চুক্তির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইঙ্গ-জাপান নৌপ্রতিদ্বন্দ্বিতা বন্ধ করা। ২. আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান, ফ্রান্স ও ইটালির মধ্যে একটি পঞ্চশক্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেখানে নির্ধারিত হয় যে, কোন দেশ কত বড় যুদ্ধজাহাজ রাখতে পারবে। জাপান প্রথমে আমেরিকা ও ব্রিটেন থেকে ছোট জাহাজ রাখার প্রস্তাবে ইতস্তত করলেও পরে মেনে নেয় কারণ প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার নৌ শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। ৩. নয়টি দেশই চীনের আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষার বিষয়ে সম্মত হয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ফলে চিন সান্টু্ং অঞ্চল জাপানের কাছ থেকে ফেরত পায়।
ওয়াশিংটন সম্মেলনের পর লন্ডন ও ওয়াশিংটনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কারণ আপাতদৃষ্টিতে এটাই মনে হয়েছিল যে এই চুক্তির ফলে জাপানকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়েছিল এবং ইঙ্গ-মার্কিন সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় ধারণাটি হিতকর হলেও প্রথমটির ফল ভালো হয়নি। ই. এইচ. কার বলেছেন ওয়াশিংটন চুক্তি সমূহের দ্বারা উদ্ভূত পরিস্থিতি ছিল নিরাপত্তাহীন। কেননা জাপান এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের ওপর থেকে তার সম্প্রসারণ নীতি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল অনিচ্ছায়। ফলে জাপানে যে নতুন আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল তাতে জাপানের ভিতরে মার্কিনবিরোধী ক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। বিক্ষোভকারীরা আমেরিকার পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছিল। জাপানি বিদেশমন্ত্রী সিদেহারা যেনতেন প্রকারে আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চেয়েছিল। প্রয়োজনে নিঃশর্ত ক্ষমাও চেয়ে নিতেন। তার এই নীতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা প্রবল সমালোচনা করেছিল। উগ্রপন্থীরা ক্ষমতায় আসার পরই জাপান ওয়াশিংটন সম্মেলনের শর্তাবলী একের পর এক লংঘন করতে থাকেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হন। সুতরাং বলাই যায় যে ওয়াশিংটন সম্মেলনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাতঃকালে জাপানের উগ্রবাদের বীজ নিহিত ছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন