মেইজি জাপানের সামন্ত প্রথার বিলোপ সাধনে কোন কোন প্রধান সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল? এই পরিবর্তনের প্রভাব গুলি কি কি ছিল / ডাইমিও, সামুরাই এবং কৃষকদের উপর এর কি প্রভাব পড়েছিল?
অথবা
মেইজি জাপানের নতুন ভূমি ব্যবস্থা প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকে কতটা পরিবর্তিত করেছিল?
মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার নায়কগন উপলব্ধি করেছিলেন যে পশ্চিমি আগ্রাসন থেকে দেশককে বাঁচাতে হলে কেবলমাত্র শোগুনতন্ত্র ধ্বংস করলেই চলবে না, জাপানকে উপরন্তু আধুনিক হতে হবে। দেশকে আধুনিক করতে হলে প্রথমে প্রয়োজন ছিল মধ্যযুগীয় সামন্ত প্রথার বিলুপ্তি। এই কঠিন কাজটি প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত বিনা রক্তপাতে সম্পন্ন হয় নি। তবে সামন্ত কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তে আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মেইজি নেতৃবর্গ সফল হয়েছিলেন। তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন শ্রেনীকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছিল।
সামন্ত প্রথার বিলোপ সাধন করে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাপানের নবগঠিত সাত-চো-হি- তো সরকার সামন্ত প্রথা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সামন্ত প্রথা বিলুপ্তির জন্য ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রত্যেক জমিদারিতে একজন করে সরকারের কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তা সত্বেও জমিদারিগুলিতে সম্রাটের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে কিডো, কোইন, সাইগো তাকামোরি প্রমূখ নেতাদের চাপে নিজনিজ গোষ্ঠীর (চোসু, সাতসুমা) বৃহৎ ভূস্বামীরা ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে নিজেদের জমিদারি সম্রাটের হাতে অর্পণ করেন। এদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অনান্য ভাইমিওগণও নিজ নিজ জমিদারি বিষয়ক দলিলপত্রাদি সম্রাটের হাতে অর্পণ করেন। যে সমস্ত জমিদার এখনো জমি ছাড়তে চাইছিল না তাদের জুলাই মাসের মধ্যে সম্রাটকে জমি দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। এরপর ১৮৭১ এর আগস্ট মাসে কয়েকটি সরকারি ঘোষণাপত্র জারি করার মাধ্যমে সামন্ত প্রথার অবসান ঘটানো হয়। তখন বাকিরা মেনে নিতে বাধ্য হয়। কারন সেই মুহূরতে তাদের সরকার বিরোধী বিদ্রোহে অংশগ্রহন করার মত ঐক্য ও ক্ষমতা ছিল না।
সামন্ত প্রথার অবসান বিভিন্ন শ্রেণীর উপর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। নতুন ব্যবস্থায় ক্ষতিপূরণ হিসাবে ডাইমিওগনের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা হয়। বলা হয় প্রতি ডাইমিও তাঁর জমিদারি থাকাকালীন প্রাপ্য জমির আয়ের ১/১০ অংশ পেনশন হিসেবে পাবেন। পরে মাসিক পেনশন বাতিল করে এককালীন একটা পাওনা দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ওদের ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব থেকে রেহাই দেওয়া হয়। সামুরাইগনের ভরনপোষণের দায়িত্ব থেকেও ওরা মুক্তি পায়। এই দায়িত্ব সরকার স্বয়ং গ্রহণ করে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ডাইমিওদের অবস্থার বিশেষ অবনতি হয়নি বলা চলে।
সরকারের এই সব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে সামুরাই শ্রেণি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শোগুনতন্ত্রের শেষদিকে সামুরাই শ্রেণীর ভাতা কমানো হয়েছিল। মেইজি সরকার এসে ওদের বংশানুক্রমিক ভাতা বন্ধ করে দেন। ওদের দেওয়া ক্ষতিপূরণের পরিমাণও যথেষ্ট ভাল ছিলনা। তাকাহাসি দেখিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে সামুরাই শ্রেণি যেসব অধিকারগুলি ভোগ করে আসছিল সেগুলি থেকে ওরা বঞ্চিত হয়। ১৮৭৩ এর সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের ঘোষণার মাধ্যমে সামুরাই শ্রেণীকে যুদ্ধ করার ঐতিহ্যগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে সামুরাইদের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে। সাতসুমা ও তোসা গোষ্ঠীর নেতারা এই অবস্থায় সামুরাইদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য ওদের কোরিয়া অভিযানে পাঠানোর প্রস্তাব করেন। কিন্তু বিরোধীদের চাপে তা বাতিল হয়ে যায়। একদিকে তীব্র অর্থসংকট অন্যদিকে ঐতিহ্যগত অধিকারের বিলোপ-- এই প্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সামুরাইরা বিদ্রোহ করে। সামুরাইদের নেতৃত্ব দেন সাইগো তাকামোরি। যদিও মেইজি কর্তৃপক্ষ সামুরাইদের বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়।
মেইজি শাসকদের কৃষি নীতির দুটি দিক। একটি হল স্থিতিশীল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়াস। এবং দ্বিতীয়টি হল Laissez faire অর্থনীতির প্রভাব। ডাইমিওদের কাছ থেকে কৃষি জমি বাজেয়াপ্ত করার পর সেগুলি কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা হয়। জমির উপর কৃষকদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত হয়। কৃষকরা আর ভূস্বামী সামন্তকে রাজস্ব দেবে না, সরাসরি রাষ্ট্রকে দেবে; তাও আবার নগদে। রাজস্ব ছাড়াও মোট উৎপাদনের ৩% ভূমি কর ধার্য করা হয়। ভূমির মূল্য অনুযায়ী ভূমি রাজস্ব নির্ধারিত হত।ব্যক্তিমালিকানার পাশাপাশি কৃষক জমির উপর বংশানুক্রমিক হস্তান্তরযোগ্য মালিকানা পায়। এর ফলে ধনী কৃষকদের সুবিধা হয়। কারণ নগদ টাকার রাজস্ব দেওয়ার চক্রে পড়ে অনেক সময় ন্যায্যমূল্যে শস্য বিক্রি করতে না পেরে কৃষক জমি বন্ধক বা বিক্রি করে দিত। জমি পরিত্যাগ করে ওরা কাজের খোঁজে শহরে চলে যেত। অনেকে আবার ধনী চাষির, যাকে জমি বিক্রি করেছিল, তার অধীনেই ভাড়াটে কৃষি মজুর হিসাবে কাজ করতে থাকে। তাই ১৮৮০ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ এর মধ্যে দেখা যায় জাপানে গ্রামীণ জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল।
মেইজি কৃষি সংস্কার কৃষিতে পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে একটি আইনে কৃষকদের কৃষি পণ্য বিক্রি করার অধিকার দেওয়া হয়, যার সুবিধা স্বাভাবিকভাবেই ধনী কৃষকরা নিয়েছিল। চীন, হংকং এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকাতেও জাপানের কৃষকেরা চাল রপ্তানি করতে শুরু করে। একদিকে নগদে রাজস্ব আদায় অন্যদিকে কৃষি পণ্য বিক্রি করার অধিকার লাভ-- এই প্রেক্ষিতে কৃষির বাণিজ্যিকিকরণ ঘটেছিল। কৃষিতে পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটে। ধনী চাষিরা ছোট চাষীদের কাছ থেকে জমি কিনে নিতে থাকে। ক্রমশ জমির বাজার গড়ে উঠতে থাকে। মেইজি শাসকদের কৃষিনীতিতে অর্থকরী ফসল উৎপাদন উৎসাহিত হয়। সরকার এক ঘোষণায় কৃষির সঙ্গে যুক্ত শিল্প গড়ে তোলার জন্য সরকার পুঁজি সরবরাহ করবে বলে। এছাড়া কৃষিবিদ্যা বিষয়ক কলেজ খোলা হয়। কৃষি সংক্রান্ত বুলেটিন প্রকাশের জন্য সরকারি ব্যয়বরাদ্দ করা হয়। বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসা হ। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে একটি কৃষি গবেষণাগারও প্রস্তুত করা হয়। রেশম রপ্তানির তত্ত্বাবধান এর জন্য একটি বোর্ড গঠিত হয়। গবাদি পশুপালন পরিদর্শনের জন্য কিছু সরকারি পদাধিকারী নিয়োগ করা হয়। সরকারি উদ্যোগে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বাদাম বীজ এবং জাভা থেকে কফির বীজ জাপানে আনা হয়েছিল। চাল ছাড়াও রেশম ও চা রপ্তানি করে জাপানি কৃষকরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে শুরু করে।
নতুন কৃষিনীতি গ্রহণের মাধ্যমে মেইজি সরকার কৃষি ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। জাপানে যে দ্রুত শিল্পায়ন হয়েছিল তার পিছনে এই নয়া কৃষিনীতির যথেষ্ট ভূমিকা ছিল কিন্তু একই সাথে এই কৃষিনীতি ছোট ও প্রান্তিক চাষীদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে উটেছিল। এর ফলশ্রুতিতে মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন