সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আকবর ও অভিজাতদের মধ্যে সম্পর্ক | Akbar and the Mughal Nobility

 আকবর ও অভিজাতদের মধ্যে সম্পর্ক 

 মুঘল শাসনের প্রধান স্তম্ভ ছিল অভিজাত সম্প্রদায়। বাবর বা হুমায়ূনের সময়ে অভিজাত সম্প্রদায়ের কোনো সঠিক সংগঠন ছিল না। আকবরই ছিলেন প্রথম মুঘল শাসক যিনি অভিজাতদের সংগঠিত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আকবর যে অভিজাত সমাজকে পেয়েছিলেন তা প্রধানত ইরানি ও তুরানি এই দুই জাতি গোষ্ঠীর আমীরদের নিয়ে গঠিত। এদের মধ্যে তুরানীদের আধিপত্য বেশি ছিল বলে মুঘল অভিজাত সম্প্রদায় ছিল মূলত তুরানী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। বৈরাম খাঁ, মির্জা নিজাত ও মির্জা হাসান ছাড়া অন্যান্য ইরানি আমিরগণ ছিলেন প্রভাব প্রতিপত্তিহীন। রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে তাদের বিশেষ ভূমিকা থাকত না ।

বৈরাম খাঁ- র মৃত্যুর পর থেকে আকবরের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারগুলি অধিকতর কার্যকর হতে শুরু হয়। ১৫৬০-৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দুটি স্থানীয় গোষ্ঠী রাজপুত ও ভারতীয় মুসলমানরা মুঘল অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। এর ফলে অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে একটা ভারসাম্য সৃষ্টি হয় এবং মুঘল প্রশাসনে তুরানি চরিত্র  ও চুগতাই পরম্পরার অবনমন ঘটে।

১৫৭৫-৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অভিজাত সংগঠনের উপর করা সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে ৫০০ বা তার বেশি উচ্চ মনসব ভোগী পদাধিকারীকদের সংখ্যা ছিল ৭৮৪। এদের মধ্যে ৩৪.৭৮ শতাংশ ছিল তুরণী, ২৫.৫৪ শতাংশ ছিল পার্সি, ১৮.৪৮ শতাংশ ছিল ভারতীয় মুসলমান, রাজপুত ও অন্যান্য হিন্দুরা ছিল ১৬.৩০ শতাংশ এবং অন্যান্যরা ছিল ৪.৮৯ শতাংশ।

ইরানি অভিজাতদের অনেকেই উজবেগ বিদ্রোহ দমনে তৎপরতা দেখিয়ে নিজেদের পদোন্নতি ঘটিয়েছিলেন। ১৫৬২-৬৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ইরানি অভিজাতদের ক্ষমতায়ন হয়েছিল এবং তারা আকবরের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখিয়েছিলেন। এই পর্বে উজবেগ বিদ্রোহ দমনে তারা আকবরের কঠোর মনোভাবকে সমর্থন করেছিল। এমনকি মির্জা সাইফুদ্দিন ও শাহ আবুল মালির বিরুদ্ধে তুর্কিরা অনুৎসাহী হলেও ইরানিরা ছিলেন সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষায় দৃঢ সংকল্প।

রাজপুত ও শেখজাদাদের সাথে বিভিন্ন উপায়ে মিত্রতা স্থাপন করে দুই সম্প্রদায়কে রাজকার্যে নিয়োগ করার ব্যাপারে আকবর উদ্গ্রীব ছিলেন। তাই রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছিল। শেখজাদাদের ক্ষেত্রেও একই রকম চেষ্টা চালানো হয়েছিল। তবে  তা সফল হয়নি। ১৫৬২  খ্রিস্টাব্দে তীর্থযাত্রা কর, জিজিয়া কর রদ করা হয়েছিল। এক মাত্র মেবার ছাড়া সমগ্র রাজপুত গোষ্ঠীগুলো আকবরকে স্বীকার করে নিয়েছিল। টোডরমল, মানসিংহ, ভগবান দাস, রাই পুরুষোত্তম, বীরবল তার ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। অভিজাত ব্যাবস্থায় রাজপুত ও শেখজাদাদের ক্ষমতায়ন আকবরের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী বিদ্রোহ গুলিতে আকবর যে ভাবে রাজপুত ও শেখজাদাদের পাশে পেয়েছিলেন সেই ভাবে তুরানিরা তো নয়ই, এমনকি ইরানীদের অনেকেই দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন।

অভিজাত ব্যাবস্থাকে সুসংহত রুপ দেয়ার জন্য আকবর এদেরকে রাষ্ট্রের বেতনভোগী ভৃত্তে পরিণত করেন। মনসবদারি ব্যাবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে অভিজাতরা তাদের বেতন, অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রিয় নির্দেশ পেয়ে যায়। তিনি অভিজাত সংগঠনকে এমন ভাবে সাজিয়ে তোলেন যাতে সম্রাটকে কোনো একটি গোষ্ঠীর উপর নির্ভর করে থাকতে না হয়। বংশমর্যাদাকে মুঘলরা নিয়োগের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গুন বলে স্বীকার করে নিলেও যোগ্যতাকেই তারা সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অভিজাতদের অধিনস্ত সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে অনুরূপ ভাবে যোগ্যতা ও মিশ্র ধরনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে ছিল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...