সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দাঁতাত এর কারণ | Reasons Behind the Detente Politics

দাঁতাত এর কারণ


বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের সময় থেকেই দুই পরস্পরবিরোধী মহাশক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পারস্পরিক সংঘাতের উত্তেজনা হ্রাস করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এই নীতি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দাঁতাত নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভাষ্যকাররা মনে করেন সমসাময়িক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি উভয়পক্ষকে দাঁতাত রাজনীতি গ্রহণে বাধ্য করেছিল। দাঁতাত এর কারণগুলো নিম্নে আলোচিত হল-

1. আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটি রাষ্ট্রই ছিল পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। উভয়পক্ষই এই চরম সত্যটা বুঝেছিলো যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার রাশ টানা না হলে তা একদিকে যেমন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, অন্যদিকে তেমনি তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাঁধা স্বরূপ হয়ে উঠবে। এর পাশাপাশি আরেকটি সমস্যা তীব্রতর হয়ে উঠেছিল-- একের পর এক দেশের পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠা। এক সময় ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন পারমানবিক বোমা নির্মাণে সক্ষম হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ইজরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, ইরাক প্রভৃতি রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের বাইরে থাকা দেশগুলিও এই সংক্রান্ত গবেষণায় দ্রুত উন্নতি করে চলছিল। এই পরিস্থিতিতে দু'পক্ষ দাঁতাতের রাজনীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

2. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা ও অর্থনৈতিক চাপ তাকে দাঁতাতের নীতি গ্রহণে বাধ্য করেছিল। একদিকে নিষ্ফল ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যয়ভার এবং অন্যদিকে পশ্চিমী দেশগুলিকে মার্শাল পরিকল্পনা অনুসারে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য যুগিয়ে যাওয়ার দরুন মার্কিন অর্থনীতি কিছুটা বেহাল অবস্থায় পড়েছিল। মার্কিন ডলারের মূল্য হ্রাস পেতে থাকে, সুদের হার বাড়তে থাকে এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা পূর্ব ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টাও করতে থাকে।

3. সোভিয়েত ইউনিয়নেও হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া এবং পোল্যান্ডে মস্কোর আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে উদারিকরণের দাবিকে সামনে রেখে বিদ্রোহ শুরু করে। মাও সেতুং এর নেতৃত্বে সাম্যবাদী চীন সোভিয়েতের সম্প্রসারণবাদ এবং ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদী নীতির সমালোচনা করেছিল। চীন সোভিয়েত সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। সোভিয়েতের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল সামরিক খাতে ব্যাপক ব্যয়। ফলে সামরিক সমঝোতার দিকে সোভিয়েত হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল।

4. তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন দাঁতাত এর আগমনকে ত্বরান্বিত করেছিল। জোট নিরপেক্ষতার মূলনীতিই ছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির ঠান্ডা লড়াই এবং তদজনিত উত্তেজনা প্রশমনের জন্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন করার চেষ্টা করেছিল। এই চাপ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার উপরেও এসেছিল। 

5. ষাটের দশক থেকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়াও চীন তৃতীয় প্রধান শক্তি হিসেবে উঠে আসে। ফ্রান্স ও ব্রিটেন পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে। পশ্চিম জার্মানিও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পূর্ব ইউরোপের যুগোস্লোভিয়া ও আলবানিয়া সোভিয়েতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার সাহস দেখিয়েছিল। ফলে, বিশ্ব রাজনীতিতে দ্বিমেরুতার পরিবর্তে বহুমেরুতার উত্থান লক্ষ্য করা যায়। সমগ্র বিশ্বের একাধিক ক্ষমতা কেন্দ্রের উপস্থিতি সোভিয়েত ও মার্কিন উভয়পক্ষকে নমনীয় হতে বাধ্য করেছিল।

6. সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি গর্বাচভ -এর নীতি 1985 সালের পর থেকে সোভিয়েত মার্কিন সম্পর্কের জটিলতা অনেকটাই দূর হয়েছিল। গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা সমৃদ্ধ তাঁর নয়া রাজনৈতিক তত্ত্বের অন্তর্গত বিষয়গুলি ছিল সমঝোতার বার্তাবাহী। ক্ষমতার ভারসাম্যর পরিবর্তে পারস্পরিক স্বার্থসমূহের ভারসাম্য রক্ষা, সংঘাতের পরিবর্ত হিসাবে সহযোগিতা, রাষ্ট্রীয়করণ এর পরিবর্তে আন্তর্জাতিকীকরণ, অস্ত্রসজ্জার বদলে নিরস্ত্রীকরণ এবং সর্বোপরি ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিবর্তে দাঁতাত ছিল গর্বাচভ নীতির মূল কথা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক