জেনেভা চুক্তি (1954) শর্তাবলী উল্লেখ করে এই চুক্তির তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ। ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের দুটি পর্ব - প্রথমটি ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম এবং দ্বিতীয়টি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম। ভিয়েতনামসহ অন্নাম, টংকিং ও কোচিন চীন তথা সমগ্র ইন্দোচীনের উপর ফরাসি উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাময়িক ভাবে ইন্দোচীন জাপানের অধীনে চলে যায়। বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর ফ্রান্স পুনরায় মার্কিন চাপের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইন্দোচীনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে উদ্যত হয়। এদিকে বামপন্থী নেতা হো-চি-মিন এর নেতৃত্বে প্রবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম গড়ে ওঠে। হো-চি-মিন এর ভিয়েতমিন বাহিনীর কাছে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে দিয়েন - বিয়েন - ফু এর যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী প্রধান জেনারেল গিয়াপ এর চূড়ান্ত পরাজয় এবং আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের অবসান ঘটে।
দিয়েন - বিয়েন - ফু এর যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবনির্বাচিত ফরাসি প্রেসিডেন্ট মেন্ডেস, যিনি যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন, দ্রুত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ইন্দোচীন সমস্যার সমাধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই প্রেক্ষিতে ২০ জুলাই, ১৯৫৪-এ জেনেভায় আহূত এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে দু'পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্তগুলি নিম্নরূপ:-
(১) ১৭⁰ অক্ষরেখা বরাবর ভিয়েতনামকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে ভাগ করা হবে। উত্তর ভিয়েতনামে থাকবে হো - চি - মিন এর ভিয়েতমিন বাহিনীর কর্তৃত্ব। সেখানে হো- র নেতৃত্বে ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সরকার প্রতিষ্ঠা হবে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে আপাতত ফরাসি বাহিনী থাকবে। সেখানে ন দিন দিয়েম এর নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
(২) ভবিষ্যতে ৬ মাসের মধ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে ফ্রান্স সেনা প্রত্যাহার করবেন।
(৩) লাওস ও কম্বোডিয়া থেকে ফরাসী সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে সেখানে পূর্বতন রাজবংশীয় শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে।
(৪) দু'বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দুই ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হবে।
জেনেভা সম্মেলন ভিয়েতনামে ঔপনিবেশিকতার আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটিয়েছিল ঠিকই, ভিয়েতনাম সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারেনি। দুই ভিয়েতনামের মধ্যে বৈরিতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামকে মদত দিতে থাকে। এমনকি সরাসরি দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষ অবলম্বন করে মার্কিন সেনা উত্তর ভিয়েতনামের উপর আঘাত হানতে থাকে। গণভোটের সিদ্ধান্ত থেকে আমেরিকা ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরে আসে। ফলে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম যুদ্ধ তথা ভিয়েতকং বনাম আমেরিকা যুদ্ধ এবং শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে মধ্য দিয়ে হো - চি - মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতকং বাহিনীর জয়লাভের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন