আকবরের দাক্ষিণাত্য অভিযান
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর থেকে মুঘলদের আত্মরক্ষার যুদ্ধ আর করতে হয়নি। এবার থেকে মুঘলরা সম্রাজ্য সম্প্রসারনের দিকে নজর দেয়। মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে সাম্রাজ্যের সর্বাধিক সম্প্রসারণ ঘটেছিল। প্রথমে উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকা দখলের পর দক্ষিণ ভারতের দিকে তিনি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। সাম্রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি পর্তুগীজদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ন্ত্রণ করাও তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। দক্ষিণ ভারতে চারটি স্বাধীন রাজ্যের উপস্থিতি ছিল- আহম্মদনগর, বিজাপুর, খান্দেশ ও গোলকুণ্ডা। বাহমনী রাজ্যের পতনের পর তার বুকের উপর এই চারটি রাজ্যের উৎপত্তি হয়েছিল। এই চারটি রাজ্যের সম্মিলিত বাহিনী বিজয়নগর রাজ্যকে তালিকোটার যুদ্ধে (১৫৬৫ খৃ:) ধ্বংস করেছিল। এই চারটি রাজ্যকে আকবর তার অধীনতা স্বীকার করে নেওয়ার জন্য দূত প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু খান্দেশ ছাড়া কোন রাজ্যেই মুঘলদের অধীনে আসতে রাজী হয় নি। তাই আকবর দাক্ষিণাত্য অভিযানের জন্য মনস্থির করেন।
আহাম্মদনগরের নাবালক সুলতান বাহাদুরকে বন্দি করে আমির গোষ্ঠীর চক্রান্তে আহম্মদ নামক এক যুবক নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করে। কিন্তু প্রাক্তন সুলতান হুসেন শাহের কন্যা এবং বিজাপুরের সুলতান আলী আজম শাহের বিধবা স্ত্রী চাঁদ সুলতানা নাবালক ও বৈধ সুলতান বাহাদুরের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং তার অভিভাবক হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল বাহিনী আহমদনগর অবরোধ করে। চাঁদ সুলতানার ডাকে বহু আমির এবং স্থানীয় শাসক মুঘলদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন। দু'পক্ষের মধ্যে একটা সন্ধি হয়, যার মাধ্যমে বেরার দিল্লি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বাহাদুরকেই আকবর আহম্মদনগরের সুলতানের স্বীকৃতি দেন। কিন্তু এই শান্তি বেশিদিন টেকেনি। চাঁদ সুলতানা গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের বাহিনীর সাহায্যে মুঘলদের বেরার থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করেন। চাঁদ সুলতানার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিনি নিহত হন অথবা আত্মহত্যা করেন। ইতিমধ্যে যুবরাজ মুরাদের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন যুবরাজ দ্যানিয়েল, যিনি আহম্মদনগরে মুঘল কার্যকলাপ সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করতে পারেননি। এই পরিস্থিতিতে আবুল ফজল ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদনগর অভিযানের দায়িত্ব পান এবং ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদনগরের অধিকাংশই অধিকৃত হয়। যদিও শাহজাহানের আগে তা সম্পূর্ণরূপে দিল্লি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি।
ইতিমধ্যে খান্দেশের সুলতান মিরন বাহাদুর দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করেন। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে আকবর স্বয়ং খান্দেশের রাজধানী বুরহানপুর অধিকার করেন এবং বিখ্যাত আসিরগড় দুর্গ অবরোধ করেন। এটিই ছিল আকবরের জীবনের শেষ যুদ্ধ। ৬ মাস অবরোধের পরও আসিরগড় দুর্গ অনধিকৃত থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে আকবর কৌশলে বাহাদুর শাহকে সন্ধির নামে দরবারে ডেকে তাঁকে দিয়ে আসিরগড় দুর্গ সমর্পণের এক নির্দেশ লিখিয়ে নেন। আকবরের এহেন বিশ্বাসঘাতকতা পন্ডিত মহলে নিন্দিত হয়েছে। যদিও এই নির্দেশপত্র লিখিয়েও কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রচুর উৎকোচ দিয়ে খান্দেশ এর কর্মচারীদের বশীভূত করে আসিরগড় দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন।
দাক্ষিণাত্যে খান্দেশ, বেরার ও আহম্মদনগর এর কিছু অংশ নিয়ে আকবর দাক্ষিণাত্য সভা গঠন করেন যুবরাজ দ্যানিয়েলের হাতে দাক্ষিণাত্য সুবার দায়িত্ব অর্পিত হয়।
অনেক পণ্ডিত আকবরের দক্ষিণ ভারত অভিযান কে শিয়া বিদ্বেষপ্রসূত অভিযান বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে কোন ধর্ম নৈতিক উদ্দেশ্যে তিনি দাক্ষিণাত্য অভিযান করেছেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে আসিরগড় দুর্গ দখলের ক্ষেত্রে তিনি যে স্বভাববিরুদ্ধ বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়েছিলেন তা অবশ্যই নিন্দাযোগ্য। খুব সম্ভবত যুবরাজ সেলিমের বিদ্রোহজনিত কারণে তিনি দ্রুত দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই আসিরগড় দুর্গ দখল অত্যন্ত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করার জন্য এই পথ অবলম্বন করেছিলেন বলে মনে হয়। যাইহোক দাক্ষিণাত্য অভিযানের সাফল্য মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানাকে যেমন বর্ধিত করেছিল তেমনি মুঘলদের উদার শাসন ব্যবস্থা দাক্ষিণাত্যে বিস্তৃত হয়েছিল। পর্তুগীজদের দমন করার যে লক্ষ্য তার ছিল, তা সফল হয়নি। তবে পর্তুগীজদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে প্রেক্ষাপট নির্মাণের প্রয়োজন ছিল দাক্ষিণাত্য অভিযানের সাফল্যের মধ্য দিয়ে তা নিশ্চিত হয়েছিল-- এ কথা বলাই যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন