সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

এনক্লোজার আন্দোলন | Enclosure Movement

 এনক্লোজার আন্দোলন

সামন্ততান্ত্রিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তোলনের ক্ষেত্রে এনক্লোজার ছিল একটি মধ্যবর্তী ধাপ। ইংল্যান্ডে প্রথম পঞ্চদশ শতকের শেষ টিউডর রাজত্বের শুরুর দিকে এনক্লোজার আন্দোলনের সূচনা হয়। কৃষিজমিকে পরিবেষ্টিত করে সেখানে ফসল উৎপাদনের পরিবর্তে পশম উৎপাদনের জন্য ভেড়া পালন করাকেই বলা হয় এনক্লোজার। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ এবং উনিশ শতকের প্রথম দুটি দশক ছিল এনক্লোজার আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায় তখন আইন এর সহায়তায় এবং শক্তি প্রয়োগের দ্বারা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কৃষিজমি কেয়া বেষ্টিত করে ভেড়া চড়ানো ব্যাপকভাবে শুরু হয়।


জমি আবেষ্টিত করার এই প্রচেষ্টায় প্রথম থেকেই যুক্ত ছিল ভূস্বামী সম্প্রদায়। আলোচ্য পর্বে একদিকে মূল্যবৃদ্ধি অন্যদিকে ভূমি রাজস্ব স্থিরীকৃত থাকার ফলে রাজস্ব বৃদ্ধি করার কোনো সুযোগ ভূস্বামীদের হাতে ছিল না। তাই ভূস্বামীরা বিকল্প পথ হিসেবে বেষ্টনী প্রথাকে বেছে নিয়েছিল। এনক্লোজার আন্দোলনের অন্যতম একটি কারণ হলো দ্রুত হারে পশম বা উলের চাহিদা বৃদ্ধি।  শুধু ইংল্যান্ডে নয়, এই সময় পশমের চাহিদা সমগ্র ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি প্রাচ্যের নানা দেশেও বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা হ্রাস এনক্লোজার আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। কৃষির প্রয়োজনে যত লোক নিয়োগ করা দরকার ছিল সেই পরিমাণ লোকের অভাব দেখা দিয়েছিল। অনেক জমি বছরের পর বছর ধরে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ভূস্বামীদের কাছে সবচেয়ে লাভজনক বিকল্পটি ছিল ভেড়া পালন।

অনেকেই অবশ্য মনে করেছিলেন যে জমি ঘেরাও করার ফলে বেকারত্ব, শস্যের চড়া দাম, খাদ্যাভাব প্রভৃতি একাধিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফসল উৎপাদনের চেয়ে ম্যাচ পালন এবং পশম উৎপাদন বেশি লাভজনক হয়ে উঠেছিল বলে জমি ঘেরাও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এই প্রবল এনক্লোজার আন্দোলন চার্চ এবং সরকার উভয়ের দ্বারাই সমালোচিত হয়েছিল। টমাস মুর আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে "শুধু গ্রাম থেকে নয়, এই প্রাণীরা শহর থেকে বিতাড়িত করবে মানুষদের।" অন্যান্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিশপ ল্যাটিমার, রবার্ট ক্রাউলি, টমাস স্মিথ প্রমুখ। 

এনক্লোজার আন্দোলনের ক্ষতিকারক প্রভাব লক্ষ্য করে টিউডর রাজতন্ত্র এনক্লোজার বিরোধী একাধিক রাজকীয় নির্দেশনামা জারি করা হয়েছিল। 1520 এর এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, চ্যান্সেলরের দপ্তরে বৈধ বলে স্বীকৃত না হলে 1485র পর তৈরি করার সমস্ত জমির বেড়া ভেঙে দেওয়া হবে। 1533 এর একটি আইনে বলা হয় জমিদার বা কৃষক 2400 এর বেশি ভেড়া পালন করতে পারবে না। একইসাথে দুটোর বেশি জমিকে engross করা যাবে না। অবশ্য আইন গুলি জারি করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কিছু স্বার্থ ছিল। কারণ জমি থেকে রাজস্ব বাবদ আয় সরকারের কমে যাচ্ছিল। যে সমস্ত কৃষক পরিবার থেকে যুবকেরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে তাদের উচ্ছেদ রাজতন্ত্রের কখনোই কাম্য ছিলনা। সর্বোপরি ভূমিহীন পরিবার গলি থেকে রাজপথে বিরোধী শক্তির আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা শাসকগোষ্ঠীর মাথা ব্যাথার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ