সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্পার্টার শাসন ব্যবস্থা | Spartan Administration

স্পার্টার শাসন ব্যবস্থা

প্রাচীন গ্রিসে গুরুত্বের বিচারে এথেন্সের সমকক্ষতা দাবি করতে পারত স্পার্টা। গ্রিসের উত্তর দিক থেকে যে সব ডোরিয়ানরা এসে ইউরোটাস নদীর উপত্যকায় বসতি স্থাপন করেছিল এবং কয়েকটি গ্রাম সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাদের বলা হত ল্যাকিডিমোনিয়। কালে কালে এই অঞ্চলে একটি নগররাষ্ট্র গড়ে ওঠে এবং অবশিষ্ট অঞ্চলের উপর প্রাধান্য স্থাপন করে। এই নগর রাষ্ট্রটি ছিল স্পার্টা। পাঁচটি গ্রামের সমন্বয়ে স্পার্টা গড়ে উঠেছিল। স্পার্টানরা ছিল ডোরিয়ানদের বংশধর। অপরাপর ল্যাকিডিমোনিয়রা পেরিঅয়কয় নামে পরিচিত হতেন। এদের রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। আর যারা ডোরিয়ান আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছিল তারা হিলট বা ক্রিতদাসে পরিণত হয়েছিল।  স্পার্টার একদিকে ছিল পারনন এবং আরেকদিকে ছিল টাইগিটাস পর্বতশ্রেণী। নগর রাষ্ট্র হিসাবে স্পার্টার এই অবস্থান তার নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করত। তবে বন্দর ছিল নগর থেকে ২৫ মাইল দূরে, ফলে স্পার্টার সামুদ্রিক বাণিজ্য ও নৈশক্তি প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছিল।  

ঐতিহ্য অনুসারে স্পার্টার শাসনতন্ত্রের প্রবর্তক ছিলেন লাইকারগাস। কিন্তু তাঁর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রকৃতপক্ষে স্পার্টার শাসনতন্ত্র কোনো একজনের সৃষ্টি নয়। ধারাবাহিক উন্নতির মধ্যে দিয়ে এই শাসনতন্ত্র গড়ে উঠেছিল। স্পার্টার শাসনতন্ত্রের চারটি অংশ ছিল- (I) দুই জন রাজা (II) গেরুশিয়া (III) অ্যাপেলো এবং (IV) ইফরগণ। এর মধ্যে প্রথম তিনটি অন্যান্য পলিসের মত একই। একমাত্র ইফরগণ ছিল স্পার্টার নিজস্ব সংগঠন।

স্পার্টার দুইজন রাজা থাকতেন। একজন এজিড কৌম থেকে এবং অন্যজন ইউরিপন্টিড কৌম থেকে। দুইজনের অধিকার প্রায় সমান হলেও এজিড রাজাদের স্থান ছিল একটু উচুঁতে। রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক। একজন রাজা যেহেতু অন্যজনকে নিয়ন্ত্রণ করত তাই হোমারীয় যুগের শেষ দিকে যখন রাজতন্ত্রের মৃত্যু হচ্ছিল তখনো স্পার্টার রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানো হয়নি। তবে রাজার ক্ষমতা ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছিল। সামরিক, বিচার এবং ধর্মীয় ব্যাপারে রাজার ক্ষমতা ছিল। কয়েকটি পুরোহিতের পদ তাদের নির্দিষ্ট থাকত। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার তাদেরই ছিল। দুজনের মধ্যে যুদ্ধযাত্রা কে করবেন জনগন তা মনোনীত করতেন। তিনটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া রাজা তার বিচারের অধিকার হারিয়েছিলেন। পেরীঅয়কয় অঞ্চলে রাজার কিছু সম্পত্তিও থাকত, যেখান থেকে তিনি রাজস্ব পেতেন। রাজার অধিকার নানাভাবে সঙ্কুচিত হলেও তার মহত্ব এবং মহিমার প্রচার চলত।

গেরুশিয়া ছিল বয়ষ্ক ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠান। এর সদস্য সংখ্যা ৩০। এর মধ্যে দুইজন ছিল রাজা। বাকি ২৮ জন ছিল ৬০ বছরের বা তার বেশি বয়সের পুরুষ, যারা অ্যাপেলো কর্তৃক নির্বাচিত হতেন। সততার পুরষ্কারস্বরুপ এই পদ দেওয়া হত। তবে শুধুমাত্র অভিজাত পরিবারের সদস্যরা গেরুশিয়ার কাজ করত। গেরুশিয়ার প্রস্তাব সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ছিল অ্যাপেলোর। অ্যাপেলোর বিকৃত সিদ্ধান্ত গেরুশিয়া নাকচ করতে পারত। গেরুশিয়ার বিচার বিভাগীয় কিছু অধিকার ছিল। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগুলি যেমন, মৃত্যু, নির্বাসন বা নাগরিক অধিকার হারানোর সিদ্ধান্তগুলি গেরুশিয়া নিত।

ত্রিশ বছর বা তার অধিক বয়সি প্রতিটি স্পার্টান অ্যাপেলোর সদস্য হতে হবে। তবে দেখা যায় নাগরিক অধিকার লাভের জন্য নির্দিষ্ট সম্পত্তির মালিকানা থাকতে হত এবং সামরিক শিক্ষা থাকতে হত। মাসে একবার অ্যাপেলোর অধিবেশন বসত। রাজা যে প্রস্তাবগুলো করতেন সেগুলো নিয়ে অ্যাপেলোতে আলোচনা হত। গেরুশিয়ার সদস্যদের ইফর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচন, যুদ্ধ ও শান্তির বিষয় বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ, রাজপদ সম্পর্কিত বিতর্ক -এই সব নিষ্পত্তি করাই ছিল অ্যাপেলোর কাজ।

ইফরগন ছিল স্পার্টার শাসনতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ইফরের সংখ্যা ছিল পাঁচ। প্রতিটি গ্রাম থেকে একজন করে ইফর নিযুক্ত হতেন। ইফরগন ছিলেন জনগণের প্রতিনিধি। ইফরদের ব্যাপক পুলিশ ক্ষমতা থাকত। জরুরি অবস্থায়, প্রয়োজন হলে তারা রাজাকেও বন্দী করতে পারত। তবে বিনা বিচারে তাঁকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারত না। হিলটদের দমনের কাজ তারই করত। বিদেশিদের অনুপ্রবেশের পর তাদেরই অনুরোধে তাঁর ভবিষ্যত নির্ধারণ হয়। দেওয়ানি মামলায় ইফরগণ ছিল সর্বচ্চ আদালত।

উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে স্পার্টার শাসনতন্ত্রেকে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র অথবা গণতন্ত্র কোনো বিশেষ একটি নামে চিহ্নিত করা যায় না, স্পার্টার শাসনতন্ত্রের এই মিশ্র প্রকৃতি ছিল তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। রবিনসনের মন্তব্য এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতে, "স্পার্টা ছিল নামে গণতন্ত্র, আকারে অভিজাততন্ত্র এবং অ্যাপেলোর দিকে নজর রাখলে বলা যায় কম বেশি রাজতন্ত্র ছিল"। ফিনলে অবশ্য অ্যাপেলোর সদস্যেদের কতটা স্বাধীনতা ছিল তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ, কঠোর সামরিক অনুজ্ঞাবর্তিতার অধীনে অ্যাপেলো টিকে ছিল।

The Governance System of Sparta

In ancient Greece, Sparta could claim parity with Athens in terms of significance. The Dorians who migrated from the northern parts of Greece and settled in the valley of the Eurotas River, establishing several village communities, were known as the Lacedaemonians. Over time, a city-state emerged in this region, establishing dominance over the surrounding areas. This city-state was Sparta. Sparta developed from the amalgamation of five villages. The Spartans were descendants of the Dorians. The other Lacedaemonians were known as Perioeci, who had no political rights. Those who failed to resist the Dorian invasion became Helots or serfs. Sparta was flanked by the Parnon and Taygetus mountain ranges, ensuring its security as a city-state. However, its port was 25 miles away from the city, hindering Sparta’s maritime trade and naval power.

According to the tradition, the lawgiver Lycurgus was the founder of Sparta’s governance system. However, his historical existence is doubtful. In reality, the Spartan constitution was not the creation of any single person but developed through continuous evolution. The Spartan constitution had four parts: (I) two kings, (II) the Gerousia, (III) the Apella, and (IV) the Ephorate. The first three were similar to other polises, but the Ephorate was unique to Sparta.

Sparta had two kings, one from the Agiad lineage and the other from the Eurypontid lineage. Although both kings had almost equal rights, the Agiad kings held a slightly higher status. The kingship was hereditary. Since one king could check the other, the monarchy in Sparta did not end even when the monarchy was declining in other parts of Greece at the end of the Homeric era. However, the kings' power gradually diminished. They had authority over military, judicial, and religious matters, held specific priestly positions, and were the supreme commanders of the army. They had the right to declare war, and the people decided which king would lead the campaign. Apart from three specific cases, the kings had lost their judicial powers. The kings also had some property in the Perioeci region from which they received revenue. Despite the reduction of their powers, the kings' grandeur and prestige continued.

The Gerousia was an institution of elderly individuals, consisting of 30 members, including the two kings. The remaining 28 were men aged 60 or older, elected by the Apella. This position was awarded as a reward for integrity. However, only members of noble families served in the Gerousia. The Gerousia proposed matters, but the final decision rested with the Apella. The Gerousia could overturn the Apella’s perverse decisions. It also had some judicial powers, making final decisions on matters such as death, exile, or loss of citizenship.

Every Spartan aged 30 or above could be a member of the Apella. However, to gain citizenship, one had to own certain property and have military training. The Apella met once a month to discuss the proposals made by the kings. The Apella elected members of the Gerousia, the Ephorate, and other significant positions, and decided on matters of war and peace, foreign policy, and disputes related to the kingship.

The Ephorate was a distinctive feature of Sparta’s governance. There were five Ephors, one appointed from each village. The Ephors represented the people and had extensive police powers. In emergencies, they could even arrest the king, though they could not detain him for long without a trial. The Ephors were responsible for suppressing the Helots and determined the fate of foreigners upon their request. In civil cases, the Ephors were the highest court.

Based on the above discussion, the Spartan constitution cannot be identified solely as a monarchy, aristocracy, or democracy. Its mixed nature was its primary characteristic. Robinson’s comment is noteworthy in this context. He stated, "Sparta was democratic in name, aristocratic in structure, and, considering the Apella, could be said to be somewhat monarchical." However, Finley expressed doubts about the actual independence of the Apella members, given that the Apella existed under strict military discipline.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ