চিনে আত্মশক্তি আন্দোলন | Self-Strenthening Movement in China
তুং চি পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে রাজপুরুষেরা চীন কে শক্তিশালী করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। চীনের শক্তি অর্জনের জন্য তারা আধুনিক শিল্পের ওপর গুরুত্ব না দিলেও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য পাশ্চাত্য প্রযুক্তি প্রয়োগ করেছিল। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার তাগিদে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় চীনের ইতিহাসে আত্মশক্তি আন্দোলন নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক ইমানুয়েল সু চীনের আত্মশক্তি আন্দোলনকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন-- 1. প্রথম পর্যায় (1861-1872), 2. দ্বিতীয় পর্যায় (1872-1885) এবং 3. তৃতীয় পর্যায় (1885-1895)
প্রথম পর্যায়ে (1861-1872) দেখা যায় যে পাশ্চাত্য প্রযুক্তির প্রয়োগে আগ্নেয়াস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি নির্মাণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। পাশ্চাত্য কারিগরি বিদ্যায় শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে, বিশেষত জাহাজ নির্মাণ ও অস্ত্র নির্মাণ কৌশল আয়ত্ত্ব করার জন্য চিনা ছাত্র-ছাত্রীদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই জন্য পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস চালানো হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগে একাধিক সামরিক শিল্প গড়ে তোলা হয়েছিল। তবে তা আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা এবং স্বজনপোষণ থেকে মুক্ত ছিল না। সামরিক ও প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার ব্যাপারে বিদেশিদের সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা আছে কি না তা যাচাই করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ নানকিং অস্ত্রাগার গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল একজন চিকিৎসক হ্যালিডে ম্যাকার্টনিকে। ফলে সাফল্য আশানুরূপ হয় নি।
দ্বিতীয় পর্যায়ে (1872-1885) সামরিক ও প্রতিরক্ষা শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সাথে সাথে জাহাজনির্মাণ, রেলপথ, খনি, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা প্রভৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নেওয়া হলো। এই পর্যায়ে আমরা দেখতে পাবো সরকারি মালিকানাধীন সামরিক শিল্পের পাশাপাশি সরকারি তত্ত্বাবধানে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের উদ্যোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চায়না মার্চেন্টস, স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি, কাইপিং কোল মাইনস, সাংহাই কটন ক্লথস মিলস, ইম্পেরিয়াল টেলিগ্রাফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রভৃতি। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পুজিতে ঘাটতি দেখা দিলে সরকার বণিকদের ঋণদানের ব্যবস্থাও করত। এই ধরনের মিশ্র উদ্যোগে আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি প্রবল হয়ে উঠেছিল। কারন সম্ভবত সংস্থা পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত সরকারি অফিসার গন পুঁজির সঙ্গে যুক্ত ছিল না বলে তাদের দায়িত্ববোধও কম ছিল।
তৃতীয় পর্যায়ে (1885-1895) আমরা দেখছি আবার সামরিক কোন শিল্প গড়ে তুলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। 1885 সালে বোর্ড অফ এডমিরালটি গঠিত হয়েছিল। 1888 সালে পেইয়াং নৌবহর গঠিত হয়েছিল। কিন্তু একই সাথে এই পর্যায়ে হালকা শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে জাতিকে সম্পদশালী করার প্রয়াস চালানো হয়েছিল। দুটো নতুন ধরনের বাণিজ্যিক উদ্যোগ এই পর্যায়ে দেখা দেয়। সরকারি ও বেসরকারি বণিকদের যৌথ উদ্যোগ এবং সম্পূর্ণ বেসরকারী ব্যক্তিগত মালিকানাধীন উদ্যোগ। কিন্তু এই দুই ধরনের উদ্যোগ এই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল এর পিছনে কারণ ছিল সরকারি কর্তৃপক্ষের ভেদনীতি এবং বণিকদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।
আত্মশক্তি আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি, যার প্রধান কারণ ছিল পরিকল্পনা গত ত্রুটি, আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ, নেতৃত্বে আঞ্চলিক মনোভাব এবং সর্বোপরি গোটা প্রক্রিয়াটির সহজাত স্ববিরোধিতা। ফলে চীন বিদেশিদের আগ্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করতে পারেনি। 1884-85 সালে চীন ফরাসি যুদ্ধ চীনের শোচনীয় ব্যর্থতা আত্মশক্তি আন্দোলনের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করেছিল। এমনকি চিন্তার বহুদিনের করদরাজ্য আন্নাম কে পর্যন্ত রক্ষা করতে পারিনি। তবে একটা ধনাত্মক দিক অবশ্যই ছিল। সেটি হল আত্মশক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়েই চিনে আধুনিক শিল্পায়নের বীজ রোপিত হয়েছিল। শিল্পায়নকে কেন্দ্র করে চিনে নগরায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
ধন্যবাদ স্যার।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ স্যার।
উত্তরমুছুন