ধ্রুপদী গ্রীসের ইতিহাসচর্চাঃ হেরোডোটাস ও থুকিডিডিস
ইতিহাস চর্চার সূচনা হয়েছিল ক্লাসিক্যাল গ্রীসে। হেরোডোটাস ও থুকিডিডিস ছিলেন এর সূচনাকারী। ইতিপূর্বে গ্রীসে গীতিকাব্য, মহাকাব্য, রাজবংশাবলী এবং ধর্মীয় গাঁথা রচনার চল ছিল, যেগুলিকে ঐতিহাসিক ট্রেভেলিয়ান Quasi-historical রচনা বলে উল্লেখ করেছেন। হেরোডোটাস ও থুকিডিডিসের রচনার সুত্র ধরেই রোম্যান্টিক ও ধর্মীয় গাঁথা থেকে ইতিহাসের মুক্তি ঘটল এবং জ্ঞানের একটি নতুন ধারা হিসাবে ইতিহাসের জয়যাত্রা সূচিত হল।
হেরোডোটাস
কেবল প্রাচীন গ্রিসেই নয় সার্বিকভাবে ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এবং ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে পুরধা ব্যাক্তি ছিলেন হেরোডোটাস। পেরিক্লিসের শাসনকালে সাহিত্য ও দর্শন চর্চার মত ইতিহাস চর্চাও এথেন্সের বৌদ্ধিক জীবনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এথেন্সের ইতিহাসচর্চার প্রথম এবং প্রধান ঐতিহাসিক ছিলেন হেরোডোটাস।
হেরোডোটাস রচিত গ্রন্থের নাম 'Histories'. এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় হল গ্রিক ও পার্সিয়ানদের মধ্যে যুদ্ধের ইতিহাস। তার ইতিহাসের সময়কাল মোটামুটি 70 বছর। হেরোডোটাসের ইতিহাস 3 টি ভাগে বিভক্ত এবং প্রতিটি ভাগ 3 টি অংশে বিভক্ত। অনেকেই মনে করেন এই বিভাজন হেরোডোটাস নিজে করেননি, পরবর্তীকালে পাঠকরা পাঠের সুবিধার্থে এই বিভাজন করেছিলেন। প্রথমভাগে আলোচিত হয়েছে সাইরাস ও ক্যামব্রাইসেস -এর রাজত্বকাল, দ্বিতীয় ভাগে আছে দরায়ুসের সম্পর্কে আলোচনা এবং তৃতীয়ভাগে আছে জারেক্সাসের কর্মকাণ্ড। তার বর্ণনায় পারসিক যুদ্ধ অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি গ্রিক ও পারসিক যুদ্ধকে দুটি বিপরীতমুখী সভ্যতা ও আদর্শের সংঘাত হিসেবে দেখেছেন। তার কাছে এই লড়াই হল প্রাচ্য দেশীয় স্বৈরতন্ত্র বনাম হেলেনীয় গণতন্ত্রের বিরোধ। এই গ্রন্থে গ্রিক সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছিল যে সভ্যতাগুলি তারও কিছু বিবরণ আছে। যেহেতু বিশ্বের সমস্ত দেশকে তিনি তার বিবরণে ছুঁয়ে গেছেন তাই সিসেরো তাকে ইতিহাসের জনক বলেছেন।
হেরোডোটাসের ইতিহাস চর্চা নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন-
1. হেরোডোটাস এথেনিয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমগ্রকে দেখিয়েছেন বলে, স্পার্টা ও করিন্থের প্রতি তিনি সুবিচার করেননি।
2. হেরোডোটাস তথ্য সংগ্রহ করেছেন কিন্তু তা যাচাই এর ব্যাপারে ততটা আন্তরিক ছিলেননা। মৌখিক তথ্যের ওপর অনেকখানি নির্ভর করছেন। তাই ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় তিনি দিতে পারেননি। যেমন, তিনি লিখেছেন নেমুকাডনেজার নারী ছিলেন, আল্পস একটি নদী, ভারতীয়রা অসুস্থ আত্মীয়দের খেয়ে ফেলে। এই ধরনের অবিশ্বাস্য এবং বিভ্রান্তিকর বিষয় তিনি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
3. তিনি ইতিহাস চর্চায় কুসংস্কার, অলৌকিক ঘটনা দৈববাণী ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, গ্রিক ও পার্সিয়ান যুদ্ধে পারস্যের পরাজয় হলো ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন। এখানে ইতিহাসের কার্যকারণ সম্পর্কের সূত্রকে অবহেলা করেছেন।
4. অনেক ক্ষেত্রেই তিনি মূল বিষয় থেকে সরে এসে অবান্তর কাহিনী লিখেছেন।
এসব সত্ত্বেও জ্ঞানের শাখা হিসাবে ইতিহাস রচনার সূচনা করে তিনি বিশ্বে জ্ঞানের নতুন দরজা খুলে দিয়েছেন।
থুকিডিডিস
হেরোডোটাসের উত্তরসূরি ছিলেন থুকিডিডিস। হেরোডোটাসকে যদি বলা হয় ইতিহাসের জনক তবে থুকিডিটিসকে বলা হয় বৈজ্ঞানিক ইতিহাস চর্চার স্রষ্টা। থুকিডিটিসের গ্রন্থের নাম 'History of Peloponnesion war' । গ্রন্থটি মোট আটটি পর্বে বিভক্ত। একদা এথেন্সের সেনাপতি হিসাবে পেলোপনেসিয় যুদ্ধে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং ব্যার্থতার জন্য নির্বাসনের শাস্তিপ্রাপ্ত জীবনের অভিজ্ঞতা তার ইতিহাস চর্চায় বিশেষ সহযোগী হোয়েছিল। তার গ্রন্থে স্থান পেয়েছে এথেন্সের শক্তি সঞ্চয় এবং এথেনিয় সাম্রাজ্যের বিস্তার, স্পার্টার পেলোপনেসিয় লীগ গঠন, যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ, পেরিক্লিসের শেষ ভাষণ প্রভৃতি। যুদ্ধের যাবতীয় বিষয় থেকে 404BCE এথেনিয় সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত তিনি তার গ্রন্থের সীমাকে দীর্ঘায়িত করেছেন।
থুকিডিটিসের ইতিহাস চর্চায় অন্যতম বৈশষ্ট্য হলো সোফিস্ট দর্শনের প্রভাব। সোফিস্ট দর্শনের বক্তব্য হলো, 'ঐতিহ্য বা কর্তৃত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ না করে, সূক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ঘটনার বিশ্লেষণ করা এবং প্রয়োজনে তার সমালোচনা করা'। এই শিক্ষাকে তিনি তার ইতিহাস লিখনে প্রয়োগ করেছেন। দ্বিতীয়ত, থুকিডিটিসের সবচেয়ে বড় গুন তিনি তথ্যের অজ্ঞানতা এবং যথার্থতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। গ্রন্থের সূচনায় তিনি নাম না করে পূর্বসূরীর সমালোচনা করে বলেছেন যে, তথ্য সংগ্রহের প্রতি প্রত্যেককে যত্নবান হওয়া উচিত। তথ্যের প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন বলে তিনি সহজেই দৈব বিশ্বাস ও জনশ্রুতিকে পরিহার করতে পেরেছেন। তৃতীয়ত, থুকিডিডিসের ইতিহাস চর্চা ছিল নিরপেক্ষ, একথা ঠিক যে তিনি প্রেরিক্লিসের প্রতি যথেষ্ট দূর্বল ছিলেন। এবং তার উত্তরসূরি ক্লিয়নের তিনি যথেষ্ট সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তার এই দৃষ্টিকোণ ছিল যুদ্ধের একটা প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার স্বর্থে।
সুতরাং, হেরোডোটাসের সময় ইতিহাসের ঢং ছিল মহাকাব্যিক, থুকিডিটিস সেখানে কাহিনীর গণ্ডি থেকে অতিক্রম করে তথ্য সমৃদ্ধ কার্যকারণ সম্পর্কে বিন্যস্ত প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তার মাথা থেকেই বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিবাদী সমালোচনামূলক ইতিহাস চর্চার সূচনা হল। তাই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি অনুসরনীয় হয়ে উঠেছেন। উভয়ের ইতিহাস চর্চার পদ্ধতি ও প্রকৃতে বিস্তর পার্থক্য স্বত্তেও অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠীর ভাষায় দুজনে ‘অসম অথচ অবিচ্ছিন্ন, পরিপন্থী তথাপি পরিপূরক’।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন