সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পলিসের পতনের কারণ | Decline of Polis

 

পলিসের পতনের কারণ 

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সূচনালগ্নে গ্রিসে পলিস বা নগর রাষ্ট্র গুলির পতন ঘটে। 431-404 খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে ঘটে যাওয়া পেলোপনিসীয় যুদ্ধের সমাপ্তির সাথে সাথে পলিসের পতনের লক্ষনগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পেলোপনিসীয় যুদ্ধের পর পলিসের যে অস্তিত্ব ছিল তা কেবল পূর্বের ছায়া মাত্র। দীর্ঘকাল যাবৎ গ্রিসের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল যে পলিস ব্যবস্থা তার পতনের কারণ অনুসন্ধানে ঐতিহাসিকগণ আগ্রহী হয়েছেন।

এথেনিয় সাম্রাজ্য ও স্পার্টার নেতৃত্বাধীন দুটি রাষ্ট্র জোটের মধ্যে দীর্ঘ 27 বছর ধরে পেলোপনেসীয় যুদ্ধ চলছিল। এই গৃহযুদ্ধে এথেন্স পরাজিত হয়; কিন্তু স্পার্টার সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। থিবস -এর কাছে স্পার্টা পরাজিত হয়। থিবস-এর রাজনৈতিক কৃতিত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। শেষ পর্যন্ত ম্যেসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ গ্রীসকে পদানত করেছিলেন।

পলিস তৈরি হয়েছিল একান্তভাবে অপেশাদার শখের কর্মীদের জন্য। পলিসের লক্ষ্য ছিল জীবনের সমগ্রতা এবং ঐক্যের দিকে। তাই পলিশের আদর্শ ছিল এই যে, এর প্রতিটি নাগরিক পলিসের বিভিন্ন কার্যাবলীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। এজন্য কোন একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন পলিস পছন্দ করত না। একজন মানুষকে যদি নিজের জন্য এবং পলিসের জন্য সব কিছু করতে হয় তাহলে সে হয় অপেশাদারী এবং সরল। এখানেই পলিসের দুর্বলতা।

প্লেটো ও অ্যারিস্টটল বলেছিলেন পলিসকে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। কিন্তু ভূমধ্যসাগর উন্মুক্ত হওয়ায় এবং বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দিতা ব্যাপক আকার ধারণ করে। এথেন্সের অভাবনীয় উন্নতি এই পরস্পরের সংঘর্ষের পথকে প্রশস্থ করে। এথেন্সের অর্থনীতির কাঠামো ছিল সয়ংসম্পূর্ণতার নীতির পরিপন্থী। সোলনের সময় থেকে এথেন্স ক্রমশ মদ, জলপাই তেল, শিল্পজাত দ্রব্য রপ্তানি এবং কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চল ও মিশর থেকে খাদ্য শস্য আমদানি করত। তাই তাকে ইজিয়ান সমুদ্রের ওপর সাধারণভাবে দর্দানালেস প্রণালীর ওপর বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে হয়েছিল। এই নিয়ন্ত্রণ ছিল পলিস ব্যবস্থার পরিপন্থী।

শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয় সামরিক ও নৌযুদ্ধের ক্ষেত্রেও পলিস সরল ব্যবস্থার বিশ্বাস ছিল। যেহেতু গ্রিসের সেনারা বেশিরভাগই ছিল পেশায় কৃষক। তাই যেকোনো দীর্ঘস্থায়ী অভিযানে ফসলের ক্ষতি হত। এজন্য যুদ্ধে দ্রুত সিদ্ধান্ত খুঁজতে হত। একমাত্র স্পার্টার সৈন্যরা ছিল পেশাদারি। পেলোপোনসিয় যুদ্ধের সময় থেকে যুদ্ধের প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। যুদ্ধ ক্রমশ একটি নিপুণ বৃত্তিতে পরিণত হয়, যা ছিল পলিসের চরিত্রের বিপরীত। নৌযুদ্ধের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। বস্তুত এই ধরনের বিশেষ দক্ষতার দাম দিতে পারত এথেন্সের সম্রাজ্য, পলিস নয়।

বানিজ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে এথেন্সের এবং তার বন্দরগুলোর সমৃদ্ধি ঘটে। এর ফলে এথেন্সের রাজনীতিতে দুইটি দল ও স্বর্থের উদ্ভব ঘটে। বানিজ্যিক শ্রেণি ছিল উগ্র গণতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদী এবং যুদ্ধবাদি। কিন্তু গ্রামীণ মানুষ যুদ্ধ পছন্দ করতনা। পেরিক্লিসের পরে এথেন্সের একলেজিয়াতে যারা এসেছিল তারা বেশিরভাগই বানিজ্যিক সম্প্রদায় থেকে এসেছিল। ফলে যুদ্ধ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সক্রেটিস ছিলেন এই নতুন নীতিবোধের অন্যতম প্রবক্তা।

সুতরাং পলিসের পতন ছিল এক উন্নতিজনক ভাঙন ক্রিয়া। এই ভঙ্গন ক্রিয়া জীবনের বাস্তবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পুরুষানুক্রমে গ্রিসে যে গতানুগতিক নীতিবোধগুলি মান্যতা পেয়ে এসেছিল যেগুলি ভেঙে পরে এবং নতুন এক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক