সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় ধর্মীয় সাহিত্যের অবদান | Ancient Indian Religious Texts as Historical Sources

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় ধর্মীয় সাহিত্যের অবদান

প্রাচীন ভারতে প্রাচীন গ্রিসের মত হেরোডোটাস বা থুকিডিডিস ছিলেন না। প্রাচীন ভারতে কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচিত হয়নি। বেশিরভাগই রচনা ছিল সাহিত্য। সাহিত্য গুলির মধ্যে আবার বেশির ভাগই ধর্মককেন্দ্রীক। ধর্মীয় সাহিত্যসম্ভার মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রচিত হলেও এগুলি থেকে ইতিহাসের বহু তথ্য সংগ্রহ করা যায়। 

প্রাচীন ভারতের প্রধান ধর্মীয় সাহিত্য হল বৈদিক সাহিত্য। বেদ চারটি: ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। প্রতিটি বেদের আবার সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। এই নিয়ে মোট বৈদিক সাহিত্য সম্ভার। ঋকবেদের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 1500 থেকে খ্রিস্টপূর্ব 1000 অব্দ পর্যন্ত। ঋগ্বেদ থেকে এই পর্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া যায়। এই পর্বকে ঋক বৈদিক যুগ বলা হয়। পরবর্তী বেদগুলি রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব 1000 অব্দ থেকে 500 খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। এই সময়কালকে পরবর্তী বৈদিক যুগ বলা হয়। পরবর্তী বৈদিক যুগের ইতিহাস চর্চায় পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যগুলি অনুরূপভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।

বৈদিক সাহিত্যের পরেই উল্লেখ করা যায় স্মৃতিশাস্ত্রগুলির কথা। স্মৃতি গ্রন্থের মধ্যে মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, বশিষ্ট্য স্মৃতি, বৃহস্পতিস্মৃতি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় পরবর্তীকালে ধর্মশাস্ত্র গুলির উপর অনেকেই টীকা লিখেছেন। যেমন মনুস্মৃতির উপর কুল্লুকভট্ট ও মেধাতিথির টীকাভাষ্য। ধর্মশাস্ত্র গুলি থেকে পাওয়া যাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবন ও রাজ্য পরিচালনা সংক্রান্ত বিবিধ উপদেশাবলী। প্রাচীনকালের বর্ণ ও জাতি ব্যবস্থা, বিবাহ প্রথা, নারীর সামাজিক অবস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, কারিগরি শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে বহু বিধি নিষেধ ও উপদেশ আমরা স্মৃতিশাস্ত্র থেকেই পাই। স্মৃতিশাস্ত্র গুলির টীকা ভাষ্যগুলি পরবর্তীকালে রচিত হওয়ায় এগুলি থেকে অনুমান করা যায় ধর্মশাস্ত্রের বিধান পরবর্তীকালে কিভাবে গৃহীত হচ্ছে।

রামায়ণ ও মহাভারত এই দুটি প্রকৃতপক্ষে মহাকাব্য। এর সঙ্গে সনাতনী হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগ জড়িত থাকায় একে ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা ভুল হবেনা। রামায়ণ রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব 200 অব্দ থেকে 200 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এবং মহাভারত রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব 600 অব্দ থেকে 400 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। মহাভারতের মূল উপজীব্য গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলের কুরু-পান্ডবদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। রামায়ণে অযোধ্যার ইক্ষাকু কুলের আদর্শ রাজা রামচন্দ্রের কীর্তিকলাপের কাব্যিক বিবরণ পাওয়া যায়। অনেক পণ্ডিত এই দুই মহাকাব্যের বাস্তব রাজনৈতিক ভিত্তি প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বাস্তবতা বা রামচন্দ্রের ঐতিহাসিকতা প্রতিপন্ন করা এখনো তর্কাতীত নয়। যাইহোক দীর্ঘকাল ধরে রচিত হওয়ার জন্য এই দুই মহাকাব্য থেকে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনশীল চরিত্র সম্পর্কে ধারনা করা যায়।

ভারতীয় সনাতনী ধর্মের শেষ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল পুরান সমূহ। পুরাণের সংখ্যা 18। এগুলির মধ্যে বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবত পুরাণ, কূর্মপুরাণ, অগ্নিপুরাণ এবং বায়ুপুরাণ উল্লেখযোগ্য। পুরানগুলির রচনাকাল কোনভাবেই গুপ্ত যুগের আগে নয়। পুরাণের রচয়িতাগন যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা আসলে নকল ভবিষ্যৎবাণী। তাই পুরাণের বর্ণনা নিয়ে সর্বদাই সংশয় থেকে যায়। তবে অন্য উপাদানের তথ্যের সাথে যাচাই করে নিয়ে পুরাণের তথ্য ঐতিহাসিকগণ ব্যবহার করে থাকেন। রামশরণ শর্মা তার সামন্ততন্ত্রের তত্ত্ব নির্মাণে পুরাণের বহু তথ্য ব্যবহার করেছেন।

ভারতবর্ষের অন্যতম দুটি প্রাচীন ধর্ম হল বৌদ্ধ ও জৈন। বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত প্রচুর গ্রন্থ রয়েছে, যেমন ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক, অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত, ললিতবিস্তর, হেমচন্দ্রের ত্রিষষ্ঠীশলাকাপুরুষচরিত ইত্যাদি। জৈন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে জৈন সূত্রাবলী, আচারঙ্গ সূত্র প্রভৃতি। এই গ্রন্থ গুলি ধর্মীয় বিষয়ের উপরে আলোকপাত করলেও সামাজিক অর্থনৈতিক ইতিহাসের বহু উপাদান এবং লোকজীবনের বহু দিক উঠে আসে।

পরিশেষে ধর্মীয় সাহিত্যিক উপাদান গুলির তথ্য ইতিহাস রচনায় ব্যবহারে সতত সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ এগুলি বেশিরভাগই ধর্মীয় চিন্তাভাবনাপ্রসূত তথ্য প্রদান করে। দ্বিতীয়তঃ এগুলির প্রতিলিপি করার সময় বদলে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।  তবে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় ধর্মীয় সাহিত্য গুলির গুরুত্বকে কোনো ভাবেই খাটো করা যায় না। যখন কোনো ইতিহাস গ্রন্থের অস্তিত্ব ছিল না তখন ধর্মীয় সাহিত্যগুলিই তথ্য সংগ্রহের একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে।

Contribution of Religious Texts to the Reconstruction of Ancient Indian History

In ancient India, there were no historians like Herodotus or Thucydides in ancient Greece. No historical texts were written in ancient India. Instead, much of the writing was in the form of literature, significantly focusing on religion. While religious literature primarily originated from religious perspectives, it provides valuable information for historical research.

The primary religious literature of ancient India is the Vedic literature. There are four Vedas: Rigveda, Samaveda, Yajurveda, and Atharvaveda. Each Veda has Samhitas, Brahmanas, Aranyakas, and Upanishads associated with it. This collection constitutes the Vedic literature. The Rigveda, which dates back to approximately 1500 to 1000 BCE, provides insights into the social, economic, political, cultural, and religious aspects of life during that period. This period is referred to as the Rig Vedic age. The subsequent Vedas were composed between 1000 BCE and 500 BCE, known as the Later Vedic Age. The historical details of this period are derived primarily from these texts.

After the Vedic literature, we can discuss about Smriti texts. These include Manusmriti, Yajnavalkya Smriti, Vasishtha Smriti, and Brihaspati Smriti, among others. Many scholars later wrote commentaries on these Smriti texts. These texts contain various instructions and guidelines related to social and economic life, and governance during ancient times. They address topics such as the caste system, marriage customs, the social status of women, trade, and craftsmanship. We find numerous prohibitions and recommendations in the Smriti texts that offer insights into the society of ancient India.

The Ramayana and Mahabharata are two epic poems of great significance in India. Along with their literary value, they are deeply intertwined with Hinduism. The Ramayana was composed between 200 BCE and 200 CE, while the Mahabharata was composed between 600 BCE and 400 CE. The Mahabharata narrates the epic rivalry between the Kuru and Pandava clans, culminating in the Kurukshetra War. The Ramayana narrates the exploits of the ideal king, Lord Rama, from the Ikshvaku dynasty, in a poetic narrative. Many scholars have attempted to use these epics to understand the historical and political contexts of ancient India, but the authenticity of the events, especially those in the Mahabharata, remains a subject of debate. Nevertheless, these two epics have played a significant role in shaping Indian society and culture over the centuries.

The Puranas are another essential category of texts in Indian literature. There are 18 major Puranas, with notable ones being the Vishnu Purana, Bhagavata Purana, Kurma Purana, Agni Purana, and Bhavisya Purana. The dating of the Puranas is not straightforward, and their descriptions are often considered more prophetic rather than historical. Still, they provide a rich source of information on ancient Indian myths, legends, and cosmology. Scholars like Ram Sharan Sharma have constructed his feudalism theory by collecting data from Puranas.

In addition to Hinduism, Buddhism and Jainism are two other major ancient religions in India. Buddhist literature includes the Tripitaka o, the Buddhacharita of Ashvaghosha, Lalitavistara, and Hemachandra's Trishashthishalakapurushacharita, among others. Jain literature comprises texts like Jain Sutras and Acharanga Sutra. While these texts primarily deal with religious topics, they also shed light on various aspects of society, economics, and daily life.

Finally, it's important to exercise caution when using religious literature in the composition of ancient Indian history. These texts often contain religious ideologies and may have undergone changes during transcription. Nevertheless, when historical texts were absent, religious literature served as the primary source of information, and they cannot be discounted when reconstructing the history of ancient India.



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক