সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পর্তুগালের সমুদ্র অভিযান | Portuguese Exploration

পর্তুগালের সমুদ্র অভিযান

পশ্চিম ইউরোপের যেসব দেশগুলির পঞ্চদশ শতক নাগাদ গুরুত্বপূর্ণ নৌ শক্তি হিসেবে আবির্ভাব  ঘটেছিল তাদের মধ্যে অগ্রণী হলো পর্তুগাল। পর্তুগিজরাই প্রথম প্রাচ্যের সঙ্গে সমুদ্রপথে সরাসরি যোগাযোগের রাস্তা খুঁজে বের করেছিল এবং নৌসাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীকালে স্পেন, হলান্ড, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স পর্তুগীজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল। পর্তুগীজদের সাফল্যের পশ্চাতে ছিল তাদের ভৌগলিক অবস্থান এবং জীবনযাত্রা। সমুদ্র সংলগ্ন হওয়ায় পর্তুগীজদের নানাভাবে সমুদ্রকে ব্যবহার করার অভ্যাস ছিল। তাছাড়া পর্তুগালের এক শক্তিশালী বণিকশ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল, যারা সামন্ততান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত ছিল এবং মদ, মাছ, লবন এর ব্যবসা থেকে বেশি লাভজনক দাস, সোনা ও গোলমরিচের ব্যবসার দিকে তারা ঝুঁকে ছিল।

দাস ও সোনার যোগান দিত আফ্রিকা। পর্তুগিজরা দীর্ঘদিন ধরে আটলান্টিকের পূর্ব দিকে ম্যাডেইরা (Madaira), অ্যাজোরি এবং কেপ ভা‌র্দে দ্বীপপুঞ্জ গুলিতে বসবাস করত। কিন্তু ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে কস্টিলের সঙ্গে পর্তুগালের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। যদিও তা শেষ পর্যন্ত একটি মীমাংসায় পৌঁছেছিল। পর্তুগাল ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জর উপর তাদের দাবি ত্যাগ করেছিল। স্পেন পশ্চিম আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্যে পর্তুগিজ অধিপত্য মেনে নিয়েছিল।

আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডে পর্তুগিজ অধিকারের সূচনা হয়েছিল 1415 খ্রিস্টাব্দে সিউটা (Ceutha) দখলের মধ্য দিয়ে। পর্তুগালের রাজকুমার হেনরি যিনি নাবিক হেনরি নামেও পরিচিত ছিলেন, সমুদ্র অভিযানে ব্যাপক উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। হেনরির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্বর্ণ ব্যবসায় উত্তর আফ্রিকার মুসলিমদের এড়িয়ে সোনার ব্যবসাকে নিজের দখলে নিয়ে আসা। কিন্তু এর জন্য দরকার ছিল নৌচালনায় দক্ষতা, মানচিত্র অঙ্কন, জাহাজ নির্মাণের উন্নত কৌশল এবং নৌ যুদ্ধে উপযোগী কামানের ব্যবহার। হেনরির নেতৃত্বে এই শর্তগুলির অধিকাংশই পুরন হয়েছিল।

হেনরির মৃত্যুর পর (1460) পরবর্তী শাসক হন দ্বিতীয় জন। দ্বিতীয় জনও সমুদ্র অভিযানে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। তারই প্রচেষ্টায় স্বর্ণের ভান্ডার গিনির উপর পর্তুগিজ অধিকার বলবৎ হয় এবং বাণিজ্যিকভাবে সোনার উৎপাদন শুরু হয়। 1470 খ্রিস্টাব্দে  পর্তুগিজরা সাও টোম দ্বীপ দখল করে সেখানে নিগ্রো দাসদের দিয়ে আখ চাষ শুরু করে। সাও টোম থেকে তারা হাতির দাঁত, মেহগনি কাঠ এবং এক ধরনের সস্তা গোলমরিচ সংগ্রহ করত। বিনিময়ে দ্বীপবাসীদের জন্য নিয়ে যেত চড়া রঙের সস্তা দরের কাপড়, আংটি, বেসলেট এবং তামার পাত্র। পর্তুগিজরা আফ্রিকা থেকেই প্রতিবছর রাজধানী লিসবনে প্রায় এক হাজার দাস আমদানি করতো। আমেরিকান সোনা স্পেনের  মারফত ইউরোপের বাজারে আসতে থাকলে আফ্রিকান সোনার বাজার কমে যায়। ফলে পর্তুগীজদের কাছে দাস ব্যবসাই ক্রমশঃ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

মসলার জন্য পর্তুগীজদের ভারতের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন জরুরী হয়ে উঠেছিল। আফ্রিকার উপকূল ধরে ভারতবর্ষে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন পর্তুগিজ নো অভিযাত্রী বারথোলোমিউ দিয়াজ। আফ্রিকার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তিনি যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন হয়ে ফিরে আসেন। ওই পথেই যাত্রা করে ভাস্কো-দা-গামা ঝড় অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছে যান। 1498 খ্রিস্টাব্দে 20শে মে তিনি মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে উপস্থিত হন। তার এই অভিযানের সাফল্যের জন্য ভাস্কো-দা-গামা ঋণী ছিলেন ভারত মহাসাগরের অভিজ্ঞ নাবিক- বণিক ইবন মাজিদের কাছে। কেননা তিনি ভাস্কো-দা-গামাকে আফ্রিকা থেকে ভারতে আসার পথ নির্দেশ করেছিলেন।

1502-3 এর মধ্যে ভাস্কো-দা-গামা যে সামুদ্রিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন তার ফলে গিনি, কঙ্গো এবং অ্যাঙ্গোলায় ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল। আটলান্টিকের বোগাডর অন্তরীপ থেকে সিংহল, প্রশান্ত মহাসাগরের মৌলুক্কাস দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত প্রায় 12,500 মাইল বিস্তৃত উপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। 1511 থেকে 1518 খ্রিস্টাব্দের মধ্য পর্তুগিজরা মালাক্কা, ক্যান্টন এবং লিউচিউ দ্বীপপুঞ্জেও পৌঁছে ছিল। 1513 খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-দা-বালবোয়া পানামা যোজক পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছেছিলেন। ফ্রান্সিস্কো-ডা-আলমিডা মিশর এবং তার উত্তরে মুসলিম রাজ্যগুলিকে বিধ্বস্ত করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মধ্যে গোয়া, মালাক্কা এবং হরমুজে পর্তুগিজরা ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। 1500 খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ পেড্রো আলভারেস কেব্রাল প্রাথমিকভাবে ভাস্কদাগামার পথ অনুসরণ করলেও এতটাই পশ্চিমে বেঁকে গেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত তিনি ব্রাজিলের উপকূলে পৌঁছেছিলেন।

পর্তুগীজদের ভারত মহাসাগরীয় নৌ সাম্রাজ্যের প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক অশীন দাশগুপ্তের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে পর্তুগীজদের হিংস্র বাণিজ্য নীতির ফলে ভারত মহাসাগরের শান্ত বাণিজ্য শেষ হয়ে যায়। ডাচ সমাজতাত্ত্বিক বার্ট্রাম শ্রিকে (Bertrom Shrieke) একই রকম মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন পর্তুগিজ অভিযান গুলিতে একটা ক্রুসেডের মেজাজ ছিল। তাই তারা মুসলিমদের জাহাজগুলি আক্রমন করত ফলে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের শান্তির নিয়ম ভেঙে পড়ে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক