সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি

তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি

উনিশ শতকের মধ্যভাগে চীনের মাঞ্চু সরকার একাধিক অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সন্মুখীন হয়েছিল যে গুলির মূলে ছিল সামন্ততান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক শেষনের ফলে জনগণের চরম আর্থিক দুর্দশা এবং দুর্ভিক্ষ। বিদ্রোহ গুলির মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হয়েছিল 1850 এর তাইপিং বিদ্রোহ।

তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃত চরিত্র নির্ণয়ে সমাজ বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিকগণ একমত হতে পারেননি। মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর বিখ্যাত 'Revolution and Counter Revolution in China' গ্রন্থে তাইপিং বিদ্রোহকে 'বুর্জোয়া সামন্ততান্ত্রিক বিপ্লব' হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি তাইপিং বিদ্রোহে ফরাসি বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে উনিশ শতকে চীনে বুর্জোয়া শ্রেণি গড়েই ওঠেনি। জেন্ট্রিদের যদি বুর্জোয়া বলা যায়, তাহলেও বলতে হবে যে এই বিদ্রোহ জেন্ট্রিদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। বরং তারা বিদ্রোহীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। জার্মান পন্ডিত Wolf Gung Frank তাইপিং বিদ্রোহের নিম্নবর্গীয় চরিত্রের দিকটি তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন নেতা থেকে সমর্থক প্রায় সকলেই ছিলেন কৃষক, মজুর বা কর্মহীনদের থেকে।

জ্যাঁ শ্যেনো দেখিয়েছেন যে, একজন দরিদ্র হতাশ এবং জীবন যুদ্ধে পরাজিত মানুষ 'ঈশ্বরভক্ত গুপ্ত সমিতি' গঠন করেছিল এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল। তিনি এই বিদ্রোহের মধ্যে কৃষক বিদ্রোহ খুঁজে পেয়েছেন। বিদ্রোহীরা যে 'মাহতি শান্তির রাজ্য' প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার করেছিল তা কেবল কৃষক চৈতন্যেই সম্ভব। বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল জমিদার এবং অত্যাচারী রাজপুরুষদের হত্যা করে জমির দলিল, ঋণপত্র ইত্যাদি নথি ধংস করে দেওয়া। দেখা গেচ্ছে যে তারা জমিদার মহাজনের বাড়ি লুট করে সেই অর্থ দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বিলি করত। যে সমস্ত এলাকা তাইপিংরা দখল করতে সক্ষম হয়েছিল সেখানকার নিহত বা পলাতক ভূস্বামীদের জমিগুলি ভাড়াটে চাষিদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়েছিল। তারা জমির খাজনা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস করেছিল। সুতরাং এই দিক থেকে বিচার করলে তাইপিং বিদ্রোহ কে কৃষক বিদ্রোহ বলা যায়।

তাইপিংরা ছিল ভীষণভাবে মাঞ্চু বিরোধী তাদের ধারণা ছিল, মাঞ্চু রাজবংশ বিদেশি তার্তার বংশদ্ভুত। এরা স্বদেশী মিং দের ক্ষমতাচ্যুত করে চিনের সিংহাসন দখল করেছিল। অপদার্থ মাঞ্চু সরকারের জন্যই চিনের মর্যাদা বিশ্বদরবারে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তাই মঞ্চুদের  ক্ষমতাচ্যুত করে চিনে এক সুষ্ঠ শাসন প্রবর্তন করতে হবে। তায়পিংরা এই মাঞ্চু বিরোধী জাতীয়বাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েই মিংদের রাজধানী নানকিংকেই রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়েছিল।

তাইপিং বিদ্রোহে আধুনিকতার স্পষ্ট প্রভাব ছিল। তারা কেবল মাঞ্চুদের হটিয়ে সিংহাসন দখল করতে চায়নি একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল। তাইপিংদের ওপর খ্রীষ্ট ধর্ম ও পশ্চিমী চিন্তা ভাবনার প্রভাব পড়েছিল। অন্যতম নেতা হুং-রেণ-গান প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়ন করেছিলেন। তাইপিং রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, আধুনিক ডাক ব্যবস্থা, ব্যাংক ও রেল ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ধর্মীয় মঠগুলিকে হাসপাতালে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাইপিংরা ‌‌পৌত্তলিকতার তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা ঘোষণা করেছিলেন।

তইপিং বিদ্রোহে সমতা ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ছিল। নানকিং -এ রাজধানী প্রতিষ্ঠার পর তারা ভূমি বন্দোবস্ত সংক্রান্ত যে দলিলটি প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়েছিল "স্বর্গের নিচে সমস্ত জমি স্বর্গের নিচের যাবতীয় মানুষ একত্রিত হয়ে চাষ করবে" তারা জমি ও সম্পত্তির ব্যাক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করেছিল। তাইপিংদের এই সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এর কাছ থেকে উচ্চোসিত প্রশংসা পেয়েছে। 

তাইপিংদের নীতি জ্ঞান ছিল অসামান্য। আফিম সেবন, জুয়া খেলা, গণিকা বৃত্তি, ব্যভিচার প্রভৃতি নিষিদ্ধ হয়। শরণার্থী ও দরিদ্রদের ত্রাণ দেওয়ার ব্যাপারেও তারা গুরুত্বূর্ণভূমিকা নিয়েছিল। ভূস্বামীদের আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তারা খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করেছিল।

সুতরাং উপরিউক্ত দিক গুলি পর্যালোচনা করলে তাইপিং বিদ্রোহকে তাই সামন্ত্রতন্ত্র বিরোধী এক সমতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত কৃষক বিদ্রোহ বলা চলে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ