ত্রিশক্তি সংঘর্ষ | Tripartite Struggle
হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল থেকে কনৌজ উত্তর ভারত তথা সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আধিপত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর অষ্টম ও নবম শতকে উত্তর ভারতে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণের জন্য আলোচ্য পর্বে তিন সমশক্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক শক্তি পাল, প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট দের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। ইতিহাসে যা ত্রিপাক্ষিক সংঘর্ষ বা ত্রিশক্তি সংঘর্ষ নামে পরিচিত।কনৌজের অবস্থান ছিল সমৃদ্ধ ও উর্বর গাঙ্গেয় উপত্যাকায়। হর্ষবর্ধনের সময় কনৌজের বৈভবের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতে। কিন্তু হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রায় 100 বছরের অরাজকতার পর্বে কনৌজ হারিয়ে ছিল তার রাজনৈতিক গৌরব। তবুও যে কোন রাজনৈতিক শক্তির কাছে কনৌজ দখল করা মানে সার্বভৌম সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ওঠা।
ত্রিশক্তি সংঘর্ষে যোগদানকারী তিনটি শক্তি হল পাল ,প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট। অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা ও মগধ কে কেন্দ্র করে গোপালের নেতৃত্বে পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। ধর্মপালের সময় পালরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অষ্টম শতকের শেষ দিকে চালুক্যদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাদেরই সামন্ত শাসক রাষ্ট্রকূটরা দাক্ষিণাত্যে আধিপত্য স্থাপন করেন। মালব ও রাজপুতণাকে কেন্দ্র করে প্রতিহারা শক্তিশালী রাজ্য গড়ে তোলে।
ত্রিশক্তি সংঘর্ষের ক্রমপরম্পরা নির্ণয় করা কঠিন। সম্ভবত কনৌজকে কেন্দ্র করে প্রথমে পাল ও প্রতিহারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে। পাল রাজা ধর্মপাল ও প্রতিহার রাজা বৎসের মধ্যে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব এর কোথাও এক জায়গায় যে যুদ্ধ হয়। তাতে পরাজিত হন ধর্মপাল। এদিকে বৎসের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব উত্তর ভারত অভিযান করেন। বৎস পরাজিত ও বিতাড়িত হন। ধ্রুবর হাতে ধর্ম পালও পরাজিত হন। যদিও এই যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে ধর্মপাল লাভবান হন। কারণ কিছু দিনের মধ্যে ধ্রুবকে দাক্ষিণাত্য ফিরে যেতে হয়। এই সুযোগে ধর্মপাল কনৌজে আধিপত্য স্থাপন করেন। তিনি বৎস অনুগামী শাসক ইন্দ্রায়ূধ কে বিতাড়িত করে চক্রায়ূধ কে সিংহাসনে বসান। মুঙ্গের লেখ থেকে জানা যায় ধর্মপাল এই সময় উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকা জয় করে শক্তিশালী শাসকে পরিণত হন। তিনি একটি সভার আয়োজন করেন, যেখানে বিভিন্ন সামন্ত রাজারা যোগ দিয়ে ধর্মপালের আনুগত্য স্বীকার করেন।
ধর্মপালের সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নাগভট্টের সময় প্রতিহাররা শক্তি অর্জন করে এবং সিন্ধু, অন্ধ্র, বিদর্ভ ও কালিঞ্জরের রাজাদের সঙ্গে মিত্রতা করে কনৌজের দিকে এগিয়ে আসেন। ধর্মপাল কে তিনি পরাস্ত করেন। এক্ষেত্রেও আবার রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারত অভিযান করে দ্বিতীয় নাগ ভট্টকে পরাজিত করেন। ধর্মপাল ও চক্রায়ূধ তার বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এবারেও তৃতীয় গোবিন্দ কে দাক্ষিণাত্যে ফিরে যেতে হয় এবং ধর্মপাল এর ফলে লাভবান হন। জানা যায় যে ধর্মপাল তার মৃত্যু পর্যন্ত কনৌজের ওপর তার অধিকার বজায় রাখতে পেরেছেন। রমেশ চন্দ্র মজুমদার মনে করেন, রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দর কাছে মাথা নত করার পরও ধর্মপাল তার আধিপত্য অক্ষুন্ন রেখে ছিলেন।
ত্রিকোণ সংঘর্ষে তৃতীয় পর্বে দেখা যায় দেবপাল প্রতিহার রাজা রামভদ্রকে পরাজিত করেন। প্রতিহার রাজা মিহিরভোজের সময় দেবপালের সাথে আরেকটি সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধের ফলে কি হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। গোয়ালিয়র লিপি থেকে জানা যায় ভোজের জয়লাভের কথা। কিন্তু বেশিরভাগ ঐতিহাসিক দেবপালের জয় হয়েছিল বলে মনে করেন। ভোজ রাষ্ট্রকূটদের সাথে সংঘর্ষেও পরাজিত হন। দেবপালের মৃত্যুর পর রাজা ভোজ কনৌজ দখল করে নেন। রাষ্ট্রকূট দের পরাজিত করে ভোজ কার্যত উত্তর ভারতের অধীশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। ভোজের পরবর্তী প্রতিহার রাজারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং রাষ্ট্রকূট তৃতীয় ইন্দ্রের কাছে পরাজিত হয়েছিল।
200 বছর ধরে চলা ত্রিশক্তি সংঘর্ষের এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী ছিল। তিনটি বৃহৎ আঞ্চলিক শক্তি পারস্পরিক লড়াইয়ে সামরিক ও আর্থিক দিক থেকে এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে তাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। বিশাল পরিমাণ সেনা বাহিনী গঠন করতে গিয়ে রাজকোষের ওপর চাপ পড়ে ছিল। রাজারা রাজস্ব এর হার ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছিল বলে সংগঠিত হয়েছিল একের পর এক কৃষক বিদ্রোহ। সামন্ত রাজারাও স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সর্বোপরি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে সাংঘাতিকভাবে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছিল তুর্কি আক্রমণ কারীরা। সুলতান মামুদ যখন ভারত আক্রমন করেন তখন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি ও সামর্থ্য কোন রাজনৈতিক শক্তির ও ছিল না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন