উগ্রবাদী ধর্মসংস্কার আন্দোলন/ এনাব্যাপটিস্ট আন্দোলন
লুথারের মৃত্যুর পর তার অনুগামীদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল এই নিয়ে যে, আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া ধর্মপালন সম্ভব কি না। লুথারের অনুগামীদের একটি অংশ লুথারবাদের সীমানাকে অতিক্রম করে অনেক বেশি বৈপ্লবিক চরিত্র লাভ করেছিল। এরা ব্যাপ্টিজমসহ সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান গুলির বিরোধিতা করেছিল। এই গোষ্ঠী অ্যানাব্যাপটিস্ট নামে পরিচিত। এরা উগ্রবাদী ধর্মসংস্কারপন্থী। প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক উভয় গোষ্ঠীকেই এরা দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করত। এরা শৈশবেই ব্যাপ্টিজম বা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার বিরুদ্ধে ছিলেন। এরা মনে করতেন খ্রিস্টান ধর্ম হল স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এক মিলনস্থল যেখানে কেবল প্রাপ্ত বয়স্কদেরই দীক্ষিত করা যায়।
জার্মানিতে খোদ লুথারের শহর উনটেনবার্গে কার্লস্টাড্ নামে এক প্রটেস্টান্ট এর নেতৃত্বে অ্যানাব্যাপটিস্ট আন্দোলনের সূচনা হয়। উইটেনবর্গের এই সংস্কার আন্দোলন একটি গনঅভ্যুত্থান এবং ধর্মীয় দাঙ্গায় পরিণত হয়। জিকাউ এর তাঁতিরা অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনকারীরা লুথার প্রদর্শিত সৎধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সব রকম বাধা অতিক্রম করতে প্রস্তুত ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে এই কাজের জন্য ঈশ্বর তাদের মর্ত্যে পাঠিয়েছেন।
সমাজের দরিদ্র মানুষের সংস্কারবাদী অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন টমাস মুনতজার। তার অনুগামীদের দৃষ্টিতে ধর্মীয় সংস্কার ছিল শুধুমাত্র পরলৌকিক মুক্তির আশ্বাস নয়, ঐহিক জীবনের সবরকম সামাজিক শোষণ থেকে মুক্তির পথ। মুনৎজার ১৫২৪ এর কৃষক বিদ্রোহকে ঈশ্বরের অভিপ্রায় বলে অভিহিত করেন। তার দৃষ্টিতে বিদ্রোহীরা ছিলেন একটি নতুন সমাজ গড়ার সৈনিক। মুনৎজারের অনুগামীদের অনেকেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো পাল্টানোর জন্য সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিসভার কল্পনাও করেছিলেন। মুনৎজার ও তার অনুগামীদের আন্দোলন দমন করা হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়।
মুনৎজারের আন্দোলনের প্রায় 100 বছর পরে মুনস্টারে বিপ্লবী প্রতিবাদী আন্দোলনের পুনরুত্থান ঘটে। এই আন্দোলনে ছিল নগরভিত্তিক।এখানে সৎধর্মে বিশ্বাসী স্বনির্ভর সম্প্রদায় গড়ে তোলা হয়েছিল। এই সম্প্রদায় আধুনিক নৈরাজ্যবাদী চেতনার সঙ্গে তুলনীয়। ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে নগরের শাসন এদের হাতে চলে যায়। এদের নেতা ছিলেন ইয়ান ম্যাথিস এবং জন নামক দুই ওলন্দাজ। এরা মনে করতেন সত্যিকারের ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকা উচিত নয়। যেহেতু ভেদাভেদের সূত্রপাত শ্রেণীভেদ এবং সম্পদ জনিত বৈষম্য, তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং মুদ্রা অর্থনীতি তারা বন্ধ করেছিল। এই ধরনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ স্বাভাবিকভাবেই অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল এবং শেষপর্যন্ত লুথারপন্থী জার্মান রাজার আক্রমণে এই সমাজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
অ্যানাব্যাপটিসদের মধ্যে প্রথম থেকেই দুই ধরনের প্রবণতা ছিল। একটি গোষ্ঠী সমাজে বৈপ্লবিক রুপান্তরে অগ্রণী ছিল। দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক সংসর্গ বাঁচিয়ে স্বনির্ভর সমাজ গড়ে তুলতে চাইত, যেখানে তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে আড়ম্বরপূর্ণ ধর্মীয় জীবন যাপন করতে পারে। সুইজারল্যান্ডের জুরিখে কনরাড গ্রাবেল ১৫২৫ সাল নাগাদ এ রকমই সমাজ গড়ে তোলে, যা সমগ্র ষোড়শ শতক ধরে টিকে ছিল। গ্রেবেলকে কলস্টাড এর সুইস কাউন্টারপার্ট বলা হয়। তিনি জুইংলির ব্যাপ্টিজম ও রাজভক্তির সমালোচনা করেছিলেন।
নৈরাজ্যবাদী অ্যানাব্যাপটিস্টরা মোরাভিয়াতেও যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। জ্যাকব হুটারের নেতৃত্বে সেখানে সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তোলা হয়। ১৫৩৫ সালে হুটারকে বিধর্মী আখ্যায়িত করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। যদিও হুটারের মৃত্যুর পর সমগ্র ষোড়শ শতক জুড়ে মোরাভিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি এলাকায় হুটারপন্থিদের অস্তিত্ব বজায় ছিল।
নেদারল্যান্ডে অ্যানাব্যাপটিস্টদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়েছিল। এক্ষেত্রে পঞ্চম চার্লস এর অত্যাচার অনুঘটকের কাজ করেছিল। নেদারল্যান্ডের নেতা ডেভিড জোরিস ছিলেন অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাসী এবং তিনি নিজেকে স্বর্ণযুগের প্রবর্তক হিসেবে মনে করতেন। তাঁর মতে মানুষের ধর্মবিশ্বাস হলো তার হৃদয়ের অনুভূতি, বাইরের আচার-অনুষ্ঠান নয়।
আপাতদৃষ্টিতে অ্যানাব্যাপটিস্ট আন্দোলনকে লুথারবাদের বিরুদ্ধে র্যাডিক্যাল প্রতিবাদী আন্দোলন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু অ্যানাব্যাপটিস্টরা কখনই ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে যায়নি, তবুও লুথার ও জুইংলির অনুগামীরা উভয়ই তাদের সহ্য করতে পারত না এবং তাদের নেতাদের নৃশংসভাবে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। আসলে লুথার ও জুইংলির অনুগামীরা নিজেদের স্বার্থকে কায়েম করার জন্য যেকোনো প্রতিহিংসার পথ বেছে নিয়েছিল। পোপের কতৃত্ববাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধ প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন শুরু হলেও নিজেরাও একসময় কর্তৃত্ববাদী হয়ে পড়েছিল। তাই অ্যানাব্যাপটিস্টরা ক্যাথলিকদের মত প্রোটেস্ট্যান্ট নেতৃত্বকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। লক্ষণীয় বিষয় এই যে অ্যানাব্যাপটিস্টদের অধিকাংশই ছিল সমাজের নিম্নবর্গের অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত লোকেরাও কিছু কিছু এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে ছিল। সমাজের উচ্চস্তরের মানুষেরা অ্যানাব্যাপটিস্টদের ভালো চোখে দেখেনি। তাই লুথারের মত এরা রাষ্ট্রীয় সমর্থন পায়নি।
পরিশেষে বলতেই হয় যে, লুথারবাদী আন্দোলনে যে দিকগুলি অবহেলিত ছিল অ্যানাব্যাপটিস্ট আন্দোলনে সেগুলি সংযুক্ত হয়েছিল। দরিদ্র, সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি বিষয় গুলি যুক্ত হয়ে এই আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। ধর্ম ছিল কার্যত আবরণ। মূল বিষয় ছিল অর্থ সামাজিক বৈষম্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন