ইউরোপে জাতি রাজতন্ত্রের উত্থান
মধ্যযুগের শেষ দিকে ইউরোপে যে বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল আঞ্চলিক রাজতন্ত্র তথা জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রবণতা। মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় বিশ্বজনীন ধারণা লক্ষ্য করা যায়, যার মূল কেন্দ্র ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য। পোপের কর্তৃত্বকে সারা খ্রিস্টান জগতে অতি পবিত্র বলে মনে করা হতো। রাজতন্ত্র তথা দেশের সার্বভৌমত্বে রাজার পূর্ণ অধিকার ছিলনা। তাকে পোপের নির্দেশ মেনে চলতে হত। রাজতন্ত্র আরও দ্বিধা-বিভক্ত ছিল সামন্ততন্ত্রের উপস্থিতির জন্য। খ্রীষ্টিয় ষোড়শ শতক থেকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের যে সূচনা হয়েছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল পোপ ও চার্চের আধিপত্যকে আস্বীকার করা এবং সামন্তপ্রভূর ক্ষমতাকে খর্ব করা। এই পরিবর্তনের অভিমুখ ছিল আঞ্চলিক রাষ্ট্রগঠনের দিকে।
সারা খ্রিস্টান জগতের একাত্মতার উপর আঘাত এসেছিল ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সাফল্যের ফলে। ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল জার্মানিতে। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্টিন লুথার। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে ইউরোপের সর্বোত্র ধর্মসংস্কারের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। ধর্মসংস্কার আন্দোলন সরাসরি ক্যাথলিক চার্চের একক আধিপত্যের দাবিকে অস্বীকার করেছিল। সংস্কারবাদীরা বিশেষ করে লুথার সুকৌশলে আঞ্চলিক রাজাদের সমর্থন আদায় করে নিয়েছিল। আঞ্চলিক রাজতন্ত্রগুলিও রোমান ক্যাথলিক চার্চের অধীনতা থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া ছিল। অন্যদিকে সংস্কার আন্দোলনকে বাঁচানোর জন্য রাজশক্তির বিরুদ্ধে গেলে সংস্কার আন্দোলনকে বাঁচানো মুশকিল ছিল। ক্যাথলিক চার্চ বনাম প্রোটেস্ট্যান্ট লড়াইয়ে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম চিন্তার জয় হয়। এই জয় একদিক থেকে আঞ্চলিক রাজশক্তির জয়। মানুষের আনুগত্য পোপের দিক থেকে সরে আসে এবং রাজার প্রতি অভিমুখ পরিবর্তন করে।
সামন্তপ্রভুদের আধিপত্যে আঘাত এসেছিল শহরবাসী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের তরফ থেকে। শহরবাসীদের মধ্যে মধ্যযুগীয় বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা সুখকর ছিল না। কারণ সামন্তপ্রভূদের লুণ্ঠন করার মনোভাব, অভিজাতদের যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং সেইসঙ্গে শুল্ক উপ-শুল্ক আদায় ইত্যাদির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শহরবাসীদের হাতে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষমতায় আসার সুযোগ রয়েছে এ কথা বুঝতে পেরে অধিকাংশ রাজাই শহরবাসীদের প্রতি অনুগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিলেন। শহরবাসীরা সামন্তপ্রভূর হাত থেকে মুক্ত হয়ে রাজাকে কর ও পরিষেবা দিতে শুরু করেছিল। কর প্রদান ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে রাজতন্ত্র কে সাহায্য করার যোগ্যতা তাদের ছিল; যেমন এরা রোমান আইনে পারদর্শী ছিল, নতুন যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। এরা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় সহজেই রাজতন্ত্রকে প্রশাসনের দিক থেকে সহযোগিতা করতে পারত। তাই রাজাও এদের পছন্দ করতেন এবং এদের নিয়োগ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। পুরোহিত বা অভিজাত সম্প্রদায়ের জায়গায় শহরবাসীই হয়ে উঠেছিল রাজার প্রধান সহযোগী।এভাবে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজতন্ত্র রাজনীতি, অর্থনীত, সমা, ধর্ম-- প্রশাসনের সব ক্ষেত্রেই নিজের প্রাধান্য স্থাপনে ও আনুগত্য আদায়ে সচেষ্ট হয়। রাজার সহযোগী হিসেবে প্রশাসক গোষ্ঠী রাজার সর্বময় কর্তৃত্ব দিয়ে প্রজার সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে। এভাবে জনসমাজে রাজার দৈব ক্ষমতাও প্রচার পেয়ে যায়।
রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অর্থ ছিল সামন্ত প্রভুদের সম্পূর্ণভাবে নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসা এবং তাদের সম্পদ উপার্জনকে রাজার নিয়ন্ত্রণে এনে রাজতন্ত্রের কাজে ব্যবহার করা। রাজার প্রশাসক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন বিভাগ যেমন প্রশাসনিক বিভাগ, আইন প্রণয়ন বিভাগ, বিচার বিভাগ প্রভৃতি গড়ে ওঠে। যাজকদের ক্ষমতারগুলি এইসব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। রাজার সামরিক বাহিনীতে কামান ও বারুদের ব্যবহার পদাতিক বাহিনীর গুরুত্বকে বাড়িয়ে দেয়। পক্ষান্তরে সামন্তপ্রভুর অশ্বারোহী নাইট বাহিনীর গুরুত্ব কমে যায়। সামন্তপ্রভুরা ক্রমশ রাজার অধীনে সামরিক বাহিনীতে পরিচালনার চাকরি গ্রহণ করে। ওদের স্বাধীন অস্তিত্ব নষ্ট হয়ে যায়।
রাজতন্ত্র যত সুদৃঢ় হয় ততই তার প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যয় বাড়তে থাকে। রাজা দেশের সম্পদের উৎস গুলি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। শহুরে মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী থেকে সমাজের সব স্তরের মানুষের থেকে কর আদায় বাধ্যতামূলক করা হয়। এইভাবে শাসন ব্যবস্থায় নতুন প্রাণ শক্তি আসে।
রাজতন্ত্র একাধারে যেমন প্রভূত ক্ষমতা ও বৃত্তের অধিকারী হয় তেমনি দেশের জনতাকে তার ফ্যাকাল্টি উন্নয়নে নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া হয়। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষা-সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য আসতে থাকে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাতে নিত্যনতুন গবেষণা, মৌলিক রচনা, আবিষ্কার এবং স্থাপত্য শিল্পের প্রভুত বিকাশ আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলির গৌরব বৃদ্ধি করে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন