কোরিয়া সংকট
ঠান্ডা যুদ্ধ কেবল ইউরোপীয় গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। যে ঘটনার মধ্য দিয়ে এশিয়া মহাদেশের ঠান্ডা যুদ্ধের প্রসার ঘটেছিল তা হল কোরিয়া যুদ্ধ (1950)। কোরিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপট আলোচনায় দুটি দিক উঠে আসে। প্রথমত চীনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সাম্যবাদী শক্তির প্রাধান্য স্থাপন। দ্বিতীয়তঃ কোরিয়ার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিভাজন এবং এক আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের অবতারণা।
1950 খ্রিস্টাব্দের পূর্বে রণকৌশলগত দিক থেকে মার্কিন বিশেষজ্ঞগণ এশিয়ার প্রতি খুব একটা নজর দেয়নি। তাদের প্রধান কামনা ছিল যাতে দ্রুত জাপানের পরাজয় ঘটে এবং চীন মার্কিনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। কিন্তু কুওমিনতাঙ দলের জনবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চিনে এক বিপ্লব ঘটে যায় এবং 1949 খ্রিস্টাব্দে মাও সেতুং এর নেতৃত্বে চীনের মূল ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। ফলে পরিস্থিতি মার্কিনের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়তঃ কোরিয়া ছিল বরাবরই বিভিন্ন বৃহৎ শক্তির লড়াইয়ের কেন্দ্রভূমি। 16-17 শতাব্দীতে কোরিয়া প্রতিবেশী জাপান ও মাঞ্চু শাসিত চীনের আগ্রাসনের বলি হয়েছিল। কোরিয়াকে কেন্দ্র করেই রুশ জাপান ও চীন-জপান যুদ্ধ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোরিয়া জাপানি দখলে চলে গেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর কোরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে মিত্রপক্ষ চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। যুদ্ধচলাকালীন 1943 খ্রিস্টাব্দে কায়রো সম্মেলন রুজভেল্ট, চার্চিল এবং চিয়াং কাইশেক কোরিয়াকে পূর্ণ স্বাধীনতা দানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। 38 ডিগ্রি অক্ষরেখার উত্তরে সোভিয়েতের এবং দক্ষিনে মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ছিল।
1945 খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরে মস্কোতে অনুষ্ঠিত একটি চুক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্থায়ী করিয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটি যৌথ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন কোরিয়া থেকে মার্কিন ও সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তাব উত্থাপন করলে আমেরিকা তাতে অসম্মতি জানায়। ফলে কোরিয়ার বিভাজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। মার্কিন প্রস্তাব মত শেষ পর্যন্ত কোরিয়াকে 38 ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর দু'ভাগে বিভক্ত করা হয়। উত্তর কোরিয়ায় কিম ইল সুং এর নেতৃত্বে বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসে এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে মার্কিন মুখাপেক্ষী সিংম্যান রী'র নেতৃত্বে একটি দক্ষিণপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্গত উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারন সভা দক্ষিণ কোরিয়ার রি প্রশাসনকে স্বীকৃতি দিলেও উত্তর কোরিয়ার ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক কে মেনে নেয়নি। দুই কোরিয়ার ঐক্যকল্পে গঠিত United Nations Commission on Korea (UNCOK) সময় মত সোভিয়েত ও মার্কিন সেনাবাহিনী অপসারণের সক্ষম হলেও কোরিয়ার ঐক্য ব্যাপারে কোন অগ্রগতি ঘটাতে পারেনি।
উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয়ই সমগ্র কোরিয়ার ওপর নিজ নিজ সার্বভৌমত্বের দাবি করছিল। দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষ সূচনা হয়েছিল 1950 সালের জুন মাসে। মে মাসে নির্বাচনে দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণপন্থীরা পরাজিত হলে উত্তর কোরিয়া উৎসাহিত হয় এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে নিজের কর্তৃত্বে আনতে ব্যাগ্র হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার রি সরকার উত্তর কোরিয়া আক্রমণের হুমকি দিয়ে বসে। উত্তেজিত হয়ে উত্তর কোরিয়া কোন রকম আগাম ঘোষণা ছাড়াই 38 ডিগ্রি অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে বসে। অতি দ্রুত তারা রাজধানী সিওল দখল করে নেয়।
এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসংঘ সক্রিয় হয়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও রাষ্ট্রসংঘ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ দেয়। উত্তর কোরিয়া অস্বীকার করলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে সামরিক অভিযান চালানো হয় বলাবাহুল্য ম্যাক আর্থার পরিচালিত এই অভিযান ছিল মূলত মার্কিন অভিযান। ইতিমধ্যে চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে ফলে যুদ্ধ আরো তীব্র হয় এবং তা চীন-মার্কিন পারমানবিক যুদ্ধে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়।
এদিকে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের পক্ষপাতমূলক আচরণ এর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলে। উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ আমেরিকাও দ্রুত এই যুদ্ধ থেকে বেরোবার পথ খুঁজতে থাকে। পরিশেষে 1954 সালের 26 এপ্রিল জেনেভা সম্মেলনে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে দুই কোরিয়ার মিলনের প্রশ্নটি অমীমাংসিতই থেকে যায় এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের পারস্পরিক বৈরিতা নিয়েই থেকে যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন