কমোডোর পেরীর অভিযান কিভাবে জাপানের দ্বার উন্মোচিত করেছিল?
১৬০০ খ্রীঃ থেকে ২৫০ বছর ধরে টোকুগাওয়া সোগুনের শাসনে জাপান ছিল একটি বদ্ধ দেশ। কেবল চীন এবং ইউরোপীয় শক্তি নেদারল্যান্ডস ছাড়া বহির্বিশ্বের সাথে জাপানের কোনো যোগাযোগ ছিল না। উনিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে পশ্চিমী শক্তি গুলি জাপানের দ্বার উন্মোচনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। প্রথমদিকে রাশিয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৪ খ্রীঃ কমোডোর পেরীর নেতৃত্ত্বে আমেরিকান প্রচেষ্টা সফল হয় এবং জাপানের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
অনেকেই মনে করেন যে পশ্চিমের সাথে যোগাযোগের পূর্বে জাপানের সমাজ ও রাষ্ট্র ছিল পরিবর্তনহীন। কিন্তু এই ধারনা সঠিক নয়। জাপানের অভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে যে একাধিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছিল তাতে মনে হয় পশিমের অভিযান কেবল অনুঘটকের কাজ করেছিল। প্রথমত, মুদ্রা অর্থনীতির সূচনা। টোকুগাওয়া শাসনে জাপানে যে long peace বিরাজ করছিল তাতে ব্যবসা বানিজ্যের অগ্রগতি ঘটেছিল। এর ফলে চিরাচরিত চাল-নির্ভর বিনিময় ব্যবস্থা অকেজ হয়ে আসছিল এবং সুবিধাজনক মাধ্যম হিসাবে মুদ্রার ব্যবহার বাড়ছিল। দ্বিতীয়ত, উদীয়মান বণিকশ্রেনী। টোকুগাওয়া জাপানে শিল্পায়ন হয়নি। কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্যের অগ্রগতির ফলে এক অর্থবান বনিক শ্রেনীর উদ্ভব ঘটেছিল। কিন্তু এদের সামাজিক অবস্থান ছিল একেবারে নিচে। অথচ এদের দেওয়া ঋণের উপর ডাইমিওরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। তৃতীয়ত, ক্ষয়িষ্ণু সামন্তপ্রভু। ঐতিহ্য অনুযায়ী জীবনযাত্রা বজায় রাখতে এবং শোগুনের প্রাসাদ এদোর নিয়মাবলী পালন করতে গিয়ে এরা প্রায়শই খরচের চাপে বণিকদের কাছে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ত। ফলে সামাজিক স্তরবিন্যাসের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। চতুর্থত, শোগুনতন্ত্রের বিদ্যাচর্চায় উৎসাহ। বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিল যারা তারা সংখ্যায় কম হলেও উপলব্ধি করেছিল যে জাপানিরা শোগুনের প্রতি যে আনুগত্য দেখায় তা সম্রাটেরই প্রাপ্য; কারন সম্রাটই দেশের প্রকৃত শাসক। তারা আরো উপলব্ধি করে যে জাপান বহিঃজগতের নিরিখে এতটাই পিছিয়ে যে পার্শ্ববর্তী ইউরোপীয় দেশ রাশিয়া যেভাবে সম্প্রসারণ করছে তাতে জাপানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একাধিক কৃষক অসন্তোষ, যেগুলির পশ্চাতে মূল কারণ ছিল দারিদ্র্য।
উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে একের পর এক পশ্চিমী চাপ আসতে থাকল জাপানের উপর। প্রথম চাপ আসে রাশিয়া থেকে। পূর্ব সাইবেরিয়া, উত্তর সাখালিন, কামচাটকা ও কিউরাল দ্বীপ্পুঞ্জে রাশিয়ার সম্প্রসাণ জাপানের শাসক শ্রেণীকে বিব্রত করে তোলে। ১৭৯২ সালে রাশিয়া প্রথম চেষ্ঠা করে জাপানের দ্বার খুলতে কারন সাইবেরিয়া ও আলাস্কায় রাশিয়ান উপনিবেশের জন্য জাপান থেকে রশদ সংগ্রহ করাতে সুবিধা হত। আফিমের যুদ্ধে চীনকে পরাজিত করে উৎসাহিত ইংল্যন্ড জাপানের দিকে বেশী করে নজর দিতে থাকে। ইতিপূর্বে তারা জাহাজ নিয়ে হোক্কাইডো(১৭৯৭) ও টোকিও উপসাগরে (১৮১৮) প্রবেশ করিয়েছিল। ১৮৫২ সালে রাশিয়ান এডমিরাল পুটিয়ানিন জাপানের সাথে একটা বাণিজ্যিক চুক্তি করার জন্য অগ্রসর হয়। কিন্তু তাঁর নাগাসাকি পৌঁছানোর আগেই আমেরিকান কমোডোর ম্যাথু পেরী জাপানে পৌছে (১৮৫৩, জুলাই) জাপান উন্মোচনের প্রথম কৃতিত্বের অধিকারী হন।
১৮৫৩ খ্রীঃ জুলাই মাসে জাপানে পৌঁছে পেরী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফিলমোরের একটি চিঠি জাপানি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়ে জানান যে আগামী বসন্তের মধ্যে এই চিঠির জবাব নিতে আবার জাপানে আসবেন। এরপর মার্কিন নৌশক্তি দেখানোর জন্য জাপানের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি এদো শহর থেকে দেখা যাবে এমন দূরত্ব পর্যন্ত গিয়ে তারপর জাপান ত্যাগ করেন। ১৮৫৪ সালে ফেব্রুয়ারীতে সাতটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে তিনি আবার ইয়েডো শহরে উপস্থিত হন এবং ভয় দেখিয়ে ৩১শে মার্চ কানাগাওয়ার সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তানুসারেঃ
১. নাগাসাকি সহ শিমোদা ও হাকেদাতে বন্দর বাণিজ্য ও রশদ সংগ্রহের জন্য মার্কিন জাহাজের কাছে উন্মুক্ত হল।
২. জাহাজডুবি হওয়া নাবিকদের জন্য যথার্থ সাহায্যের ব্যবস্থা হল।
৩. শিমোদা বন্দরে একজন মার্কিন কনসাল থাকার অনুমতি মিলল।
৪. আমেরিকা জাপানে Most Favoured Country র স্বীকৃতি পেল।
কানাগাওয়ার অনুরূপ চুক্তি জাপানকে গ্রেট ব্রিটেন (১৮৫৪), রাশিয়া (১৮৫৫) এবং হল্যান্ডের (১৮৫৬) সাথে স্বাক্ষর করতে হল। এই তিনটি দেশ অতি আঞ্চলিক অধিকারও আদায় করে নিল, যা কানাগাওয়া চুক্তিতে ছিল না।
কানাগাওয়া চুক্তির শর্তানুসারে আমেরিকান কনসাল হিসাবে অভিজ্ঞ টাউন্সেন্ড হ্যারিস শিমোদাতে উপস্থিত হন। জাপানের পূর্ণরূপে দ্বার উন্মোচনে হ্যারিসের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি জাপানিদের বিশ্বাস অর্জনে সফল হন। ১৮৫৭ সালে তিনি শিমোদা ও হাকোদাতে এলাকায় মার্কিনদের বসবাসের অনুমতি লাভ করেন এবং ফৌজদারি মামলায় অতিরাষ্ট্রিক অধিকার অর্জনে সক্ষম হন। এমনকি তিনি শোগুনের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি পর্যন্ত পেয়ে যান।
পশ্চিমীদের আসল লক্ষ্য ছিল জাপানের সাথে একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন করা, যা তিনটির কোনোটাই ছিল না। ইতিমধ্যে দ্বীতিয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধে চীনের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ফলে জাপান আর কোনো বিরোধিতায় যেতে চায় নি। তাই ১৮৫৮ খ্রীঃ ২৯শে জুলাই আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে হ্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্তানুসারেঃ
১. দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক আদান প্রদানের ব্যবস্থা হয়।
২. আরো কয়েকটি বন্দর বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত হয়, যথা কানাগাওয়া ও নাগাসাকি। এও বলা হয় যে ১৮৬০ এ নিগতাই ও হিয়োগো বন্দর বানিজ্যের জন্য এবং ১৮৬৩ তে এদো ও ওসাকা বসবাসের জন্য উন্মুক্ত হবে।
৩. আমদানী ও রপ্তানী পণ্যের উপর জাপান ৫% এর বেশী শুল্ক ধার্য করতে পারবে না, তা-ও আবার মার্কিন কনসালের অনুমতিসাপেক্ষ হতে হবে।
৪. ফৌজদারীর পাশাপাশি এবার দেওয়ানীর মামলাতেও আমেরিকানরা জাপানে অতিরাষ্ট্রিক অধিকার পাবে।
৫. জাপানে তারা সম্পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা পাবে।
৬. পরিবর্তে জাপানকে আমেরিকা অস্ত্রশস্ত্র ও জাহাজ দিয়ে সাহায্য করবে।
হ্যারিস চুক্তির তিন মাসের মধ্যে হল্যান্ড, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া জাপানের কাছ থেকে অনুরূপ সুবিধা আদায় করে নেয়। এভাবে বিনা রক্তপাতে রুদ্ধদ্বার জাপানের উন্মুক্তিকরণ ঘটে, যা চীনের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বিপরীত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন