পূর্ব ইউরোপে স্ট্যালিনিকরণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দুই সুপার পাওয়ার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল তার অন্যতম পদক্ষেপই ছিল মিত্ররাষ্ট্র তথা প্রভাবাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রতিদ্বন্দ্বীতা। একদিকে আমেরিকা যেমন পশ্চিম গোলার্ধে তার একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল তেমনি অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছিল। সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে পরিকল্পিতভাবে পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিস্তার ঘটানোর এই পদক্ষেপ Stalinization নামে পরিচিত।
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েতিকরণের প্রক্রিয়া চলেছিল 1946 থেকে 1952 খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত। এই সময়কালে পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরী, চেকোস্লোভাকিয়া ও যুগোস্লাভিয়ায় সোভিয়েত সহযোগিতায় সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছিল। সোভিয়েতিকরনের পশ্চাতে প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। স্ট্যালিন নিজেই জানিয়েছিলেন যে, যুদ্ধজনিত পরিস্থিতিতে সোভিয়েত রাশিয়ার নিরাপত্তার স্বার্থেই দখলীকৃত পূর্ব ইউরোপে রুশ প্রভাব বৃদ্ধি জরুরি ছিল। পশ্চিমী শক্তিবর্গ এক্ষেত্রে বিশেষ কোনো বাধা দেয়নি; কারণ সোভিয়েত লালফৌজই পূর্ব ইউরোপের ভূখণ্ড থেকে জার্মান বাহিনী কে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। 1945 খ্রিস্টাব্দে ইয়াল্টা সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ইউরোপ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা করলে সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি সোভিয়েতের অনুকূলে গিয়েছিল। অনেকেই বলে থাকেন পূর্ব ইউরোপের আধিপত্য কায়েম ছিল পুরোপুরি একটা বোঝাপড়া, যা রুজভেল্ট চার্চিল ও স্তালিনের মধ্যে ইয়াল্টা সম্মেলনে সমঝোতা হয়ে গেছিল। পিটার ক্যালভোকোরেসি অবশ্য এইসব সমঝোতার কথা মানেন না। তাঁর মতে পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত আধিপত্যবাদের উৎস নিহিত ছিল স্ট্যালিনের সামরিক সাফল্যের মধ্যেই।
স্টালিনিকরণের প্রক্রিয়াকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে(1945-47) পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরিতে সমাজতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 1945 এ পোল্যান্ড রুশ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং সেখানে সর্বদলীয় যৌথ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। যেখানে অকমিউনিস্টদের প্রভাব খুবই কম ছিল। 1947 এ সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্টরা সিংহাসন দখল করে সেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। পুরানো পলিশ পেজেন্টস পার্টি দ্রুত গুরুত্ব হারায়।
নাৎসী বিজয়ের পর রোমানিয়ায় 1945 সালে স্ট্যালিনের ইচ্ছানুসারে পূর্বতন রাজার নেতৃত্বে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার আত্মপ্রকাশ করে। 1947 সালে বিশিষ্ট কৃষক নেতা Ion Maniu এর বিরুদ্ধে মার্কিন ও ব্রিটিশ এজেন্টের সঙ্গে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্ত যুক্ত থাকার অভিযোগ নিয়ে আসা হয়। বিচারে তিনি ও তার অনুসারীরা দোষী সাব্যস্ত হন। পেজেন্টস পার্টি ভেঙে দেওয়া হয়। রাজা ওই বছরই পদত্যাগ করেন। 1948 সালে নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি মিশে গিয়ে 414 টি আসনের মধ্যে 405 টি আসন দখল করে। এভাবে রোমানিয়ায় সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়।
বুলগারিয়াতে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফাদারল্যান্ড ফ্রন্ট নামে যে সর্বদলীয় মোর্চা গড়ে উঠেছিল সেখানে কমিউনিস্টদেরই প্রভাব বেশি ছিল। কমিউনিস্টরা এখানে অপরাপর দল ও গোষ্ঠী গুলিকে ক্রমশ নির্মূল করে 1947 সাল নাগাদ একটি সোভিয়েতমুখী বামপন্থী সরকার গড়ে তোলে যার নেতৃত্বে ছিলেন, জর্জি দিমিত্রভ। Agrarian Party র প্রভাবশালী নেতা নিকোলা পেটকভকে কমিউনিস্ট বিরোধিতার জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
হাঙ্গেরিতে সোভিয়েতিকরণ হয়েছিল পুরোপুরি ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। 1946 সালে হাঙ্গেরিতে রাজতন্ত্রের অবসান এরপর ছোট মাপের ভূস্বামীদের নিয়ে গঠিত স্মল হোল্ডার্স নামে একটি দল এবং সমাজতন্ত্রী দল একটি জোট সরকার গঠন করেছিল। তারপর কমিউনিস্টদের একের পর এক রাষ্ট্রদোহিতার মিথ্যা অভিযোগ এনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। 1947 সালের মে মাসে এই সরকারের পতন ঘটে এবং আগস্ট মাসে যে নির্বাচন হয় তা ছিল তাতে জালিয়াতি করে হাঙ্গেরিতে Arpad Szakasits এর নেতৃত্বে National Independence Front ক্ষমতায় আসে। 1949 সালের কুড়ি আগস্ট হাঙ্গেরিতে বামপন্থী গণপ্রজাতন্ত্র গঠিত হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে (1948-53) দেখা যায় একদিকে চেকোস্লোভাকিয়া আয় কমিউনিস্ট শাসন কায়েম হচ্ছে এবং অন্যদিকে সোভিয়েত আধিপত্যবাদের সমালোচনা করায় যুগোস্লোভিয়াকে সোভিয়েত বলয় থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। চেকোস্লোভাকিয়া ছিল গণতন্ত্রপ্রেমী। চেক জনগণের সমাজতন্ত্রের প্রতিও স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল। তাই অন্য দেশগুলোর মতো সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল না। জার্মানির কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর 1946 সালের নির্বাচনে কমিউনিস্টরা সর্বোচ্চ 39 শতাংশ ভোট পেয়ে গটওয়ার্ল্ড এর নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। এদিকে চেক রাষ্ট্রপতি এডওয়ার্ড বেনেস সাম্যবাদ ও পুঁজিবাদের মাঝামাঝি একটি ব্যবস্থা কায়েম করার পক্ষে ছিলেন। বেনেস ও তাঁর সহযোগীরা মার্শাল পরিকল্পনার শর্তগুলি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মতবিরোধ শুরু হয়। স্ট্যালিনের অঙ্গুলিহেলনে প্রধানমন্ত্রী গটওয়ার্ল্ড বিরোধী দলগুলোর ওপর আক্রমণ হতে শুরু করেন। দুইজন চেক মন্ত্রী সন্দেহজনকভাবে নিহত হন। রাষ্ট্রপতি বেনেস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এভাবে চেকোস্লোভাকিয়া একছত্র সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর পাঁচটি পূর্ব ইউরোপীয় কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের মত যুগোস্লাভিয়ার জার্মান বিতরণ এবং বামপন্থী শাসন প্রবর্তনের সোভিয়েত সহযোগিতার দরকার হয় নি। নিজের বলে যুগোশ্লাভ গণফৌজ মার্শাল টিটো নেতৃত্বে এই কাজ সম্পন্ন করেছিল। তাই টিটো সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রিকৃত সাম্যবাদী জোটের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না, যা স্টালিনকে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল। তাছাড়া বিশ্ববিপ্লবের তত্ত্বের প্রতি টিটোর সমর্থন স্ট্যালিনের ক্রোধের আরো একটি কারণ। টিটো বলকান ফেডারেশন গঠনের যে স্বপ্ন দেখছিল তা পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত কর্তৃত্বকে ক্ষুন্ন করতে পারত। সম্ভবত এই কারণেই সোভিয়েত বলয় (কমিনফর্ম) থেকে স্ট্যালিন টিটোকে কেবল বহিষ্কার করলেন না তারওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাও চাপালেন। এই সময় টিটো জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হলেন।
বস্তুতপক্ষে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েতিকরণ একদিকে যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে লাভজনক হয়েছিল অন্যদিকে এই ব্যবস্থা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা মজবুত হয়েছিল এবং ওই অঞ্চলের সম্পদ সম্ভাবনাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সোভিয়েত অর্থনীতি পুনর্গঠন এর ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যবহার করতে পেরেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সোভিয়েতিকরণ প্রক্রিয়া যতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তার থেকে অনেক বেশি ছিল গাজোয়ারি। তাই জনগণের বিক্ষোভ ক্রমশ ধূমায়িত হতে থাকে এবং স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরই ওই সমস্ত এলাকায় একের পর এক বিদ্রোহ দেখা দেয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন