সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চীন - সোভিয়েত সম্পর্ক

চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক

1949 সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থান বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাশিয়ার পর মাও সে তুং এর নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব এর মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট চীনের আবির্ভাব বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন কে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল। তাই চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পারস্পরিক সম্পর্ক পর্যালোচনা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে একটি আকর্ষণের বিষয হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন সোভিয়েত সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি পর্যায়ে লক্ষ্য করা যায়। প্রথমটি 1949 থেকে 1956 সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় টি 1956 সাল থেকে 1990 পর্যন্ত।

প্রথম পর্ব 

চীন সোভিয়েত সম্পর্কের প্রথম পর্বটি ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আনুগত্য ও দায়বোধ ছাড়াও চীনের পক্ষে সোভিয়েতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার একটা বাধ্যবাধকতা ছিল। কারণ বিশ্ব পুঁজিবাদী দেশগুলি বিশেষ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সাম্যবাদী চীনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা চীনকে স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি চীনকে নাস্তানাবুদ করার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা পুঁজিবাদী বিশ্ব করে গেছিল। তাছাড়া জাপানি সাম্রাজ্যবাদের পুনরুত্থানের একটা আশঙ্কাও চীনকে তাড়া করে বেড়াত। তাই সদ্যোজাত চীন অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে প্রয়োজনে সোভিয়েত মিত্রতা ছিল অনেক বেশি নিরাপদ।

1949 এর 16 ই ডিসেম্বর চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ থেকে দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। 1950 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চীন সোভিয়েত সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে চীন পেয়েছিল চ্যাংচুন রেলপথ, প্রচুর পরিমাণে সোভিয়েত ঋণ ও অনুদান। দুটি রাষ্ট্র সমঝোতায় এসেছিল যে কোন একপক্ষ শত্রুরাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে যৌথভাবে তার মোকাবিলা করা হবে।চীনের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন এ ও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে এই চুক্তির ব্যাপক গুরুত্ব ছিল। চিনা নেতৃত্ব এক্ষেত্রে সোভিয়েত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পেরেছিল। চুক্তিতে স্থির হয়েছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পাঁচ বছরের জন্য বার্ষিক 1% হারে সুদে 500 মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে এবং এর পাশাপাশি অন্যান্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে। যেমন জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে তেল উত্তোলনে যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, বিমান চলাচলে প্রযুক্তিগত সহায়তা দান ইত্যাদি। এই উপলক্ষ্যে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা চীনে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছিল। 1952 সালে চীনের বিদেশমন্ত্রী চৌ এন লাই সরকারিভাবে মস্কো ভ্রমণে আসেন এবং তার পরই চীন সোভিয়েত মডেলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু করে।

প্রথম পর্বে চীন সোভিয়েত মৈত্রী সম্পর্কের অন্যতম ভিত্তি ছিল দুই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের একটি সাধারন লক্ষ্য: সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রসারে উৎসাহ প্রদান এবং শত্রু পুঁজিবাদী শক্তি জোটের নেতা মার্কিন প্রশাসনের কাজকর্ম সম্পর্কে সতর্ক থাকা। চীন তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ব্যাপারে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল। চীন-সোভিয়েত সুসম্পর্ক চীনের সেই উদ্বেগ দূর করেছিল। অন্যদিকে  সোভিয়েতের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বন্ধুত্ত্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে উদ্দীপ্ত করেছিল এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের সোভিয়েতের অবস্থানকে সুদীর্ঘ করেছিল।

দ্বিতীয় পর্ব

স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ জামানায় চীন-সোভিয়েত সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ক্রুশ্চেভের Destalinization নীতি মাও সেতুং কে হতাশ করেছিল। মাও এর মতে ক্রুশ্চেভের স্ট্যালিন বিরোধী নীতি আসলে সমাজতন্ত্রের ভিত্তি মার্কসবাদ এবং লেনিনবাদকে আক্রমণ করছে। তিনি ক্রুশ্চেভের সংস্কার গুলিকে প্রতিক্রিয়াশীল সংশোধনবাদী সংস্কার বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে  ক্রুশ্চেভ পরিকল্পিত ওয়ারশ চুক্তি ছিল সোভিয়েত স্বার্থে গঠিত আদর্শহীন নিছক সামরিক জোট।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে সোভিয়েত ছক বিশেষ কার্যকর হয়নি। 1958 খালের দুর্ভিক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চীনকে কোনরকম সাহায্য করেনি। মাও সে তুং চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তৃতীয় বিশ্ব সুলভ মডেল সন্ধানে উদ্যোগী হলেন। তার অভিনব সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রিট লিপ ফরওয়ার্ড সাময়িকভাবে অকার্যকর হলে ক্রুশ্চেভ এই নীতি কে পেটি বুর্জোয়া নীতি বলে সমালোচনা করেন ইতিমধ্যে 1959 সালে সেপ্টেম্বরে ক্রুশ্চেভ মার্কিন মুলুক সফর করলে চীন সোভিয়েত সম্পর্ক আরো খারাপ হয়ে যায়। ক্রুশ্চেভের এই মার্কিন প্রীতিকে চীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পক্ষে ক্ষতিকর বলে অভিহিত করেন। এই প্রেক্ষিতে সোভিয়েত নেতৃত্ব চীন থেকে রুশ বিশেষজ্ঞ ও প্রযুক্তিবিদদের ফিরিয়ে নেয় এইভাবে চীন সোভিয়েত অর্থনৈতিক সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে।

1962 সালে ভারত-চীন সীমান্ত যুদ্ধ কে কেন্দ্র করে চীন সোভিয়েত সম্পর্ক আরো খারাপ হয়। সোভিয়েত প্রশাসন এই যুদ্ধে ভারতের পক্ষ নিল। এর প্রতিক্রিয়ায় 1968র চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত হস্তক্ষেপকে চিন সমালোচনা করে। শত্রুতা এমন জায়গায় চলে যায় যে চীন-সোভিয়েত সীমান্ত সংঘর্ষ পর্যন্ত হতে পারত।

1976 সালে মাও সে তুং এর মৃত্যুর পরেও চীন-সোভিয়েত সম্পর্কে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং সোভিয়েত সমর্থিত ভিয়েতনামি বাহিনীর কাম্বোডিয়া আক্রমণ, চীন-ভিয়েতনাম সীমান্ত যুদ্ধ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণের মতো ঘটনার পরিণতিতে চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক খারাপ হতে থাকলো 1979 সালে চীন 1950 এর গোড়ায় স্বাক্ষরিত চুক্তি নবীকরণ করতেও রাজি হয়নি।

 তবে 1980 দশকের গর্বাচেভের সময় থেকে চীন সোভিয়েত সম্পর্ক আবার উষ্ণ হতে থাকে। দুপক্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গর্বাচেভ চীন সফর করেন। দেন জিয়াও পিং মাও সেতুংয়ের চরমপন্থী নীতি থেকে সরে আসেন। চীনের বাজার পুঁজির জন্য মুক্ত হয়। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার গুরুত্ব প্রকাশ পায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...