চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক
প্রথম পর্ব
চীন সোভিয়েত সম্পর্কের প্রথম পর্বটি ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আনুগত্য ও দায়বোধ ছাড়াও চীনের পক্ষে সোভিয়েতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার একটা বাধ্যবাধকতা ছিল। কারণ বিশ্ব পুঁজিবাদী দেশগুলি বিশেষ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সাম্যবাদী চীনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা চীনকে স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি চীনকে নাস্তানাবুদ করার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা পুঁজিবাদী বিশ্ব করে গেছিল। তাছাড়া জাপানি সাম্রাজ্যবাদের পুনরুত্থানের একটা আশঙ্কাও চীনকে তাড়া করে বেড়াত। তাই সদ্যোজাত চীন অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে প্রয়োজনে সোভিয়েত মিত্রতা ছিল অনেক বেশি নিরাপদ।
1949 এর 16 ই ডিসেম্বর চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ থেকে দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। 1950 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চীন সোভিয়েত সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে চীন পেয়েছিল চ্যাংচুন রেলপথ, প্রচুর পরিমাণে সোভিয়েত ঋণ ও অনুদান। দুটি রাষ্ট্র সমঝোতায় এসেছিল যে কোন একপক্ষ শত্রুরাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে যৌথভাবে তার মোকাবিলা করা হবে।চীনের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন এ ও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে এই চুক্তির ব্যাপক গুরুত্ব ছিল। চিনা নেতৃত্ব এক্ষেত্রে সোভিয়েত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পেরেছিল। চুক্তিতে স্থির হয়েছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পাঁচ বছরের জন্য বার্ষিক 1% হারে সুদে 500 মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে এবং এর পাশাপাশি অন্যান্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে। যেমন জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে তেল উত্তোলনে যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, বিমান চলাচলে প্রযুক্তিগত সহায়তা দান ইত্যাদি। এই উপলক্ষ্যে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা চীনে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছিল। 1952 সালে চীনের বিদেশমন্ত্রী চৌ এন লাই সরকারিভাবে মস্কো ভ্রমণে আসেন এবং তার পরই চীন সোভিয়েত মডেলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু করে।
প্রথম পর্বে চীন সোভিয়েত মৈত্রী সম্পর্কের অন্যতম ভিত্তি ছিল দুই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের একটি সাধারন লক্ষ্য: সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রসারে উৎসাহ প্রদান এবং শত্রু পুঁজিবাদী শক্তি জোটের নেতা মার্কিন প্রশাসনের কাজকর্ম সম্পর্কে সতর্ক থাকা। চীন তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ব্যাপারে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল। চীন-সোভিয়েত সুসম্পর্ক চীনের সেই উদ্বেগ দূর করেছিল। অন্যদিকে সোভিয়েতের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বন্ধুত্ত্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে উদ্দীপ্ত করেছিল এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের সোভিয়েতের অবস্থানকে সুদীর্ঘ করেছিল।
দ্বিতীয় পর্ব
স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ জামানায় চীন-সোভিয়েত সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ক্রুশ্চেভের Destalinization নীতি মাও সেতুং কে হতাশ করেছিল। মাও এর মতে ক্রুশ্চেভের স্ট্যালিন বিরোধী নীতি আসলে সমাজতন্ত্রের ভিত্তি মার্কসবাদ এবং লেনিনবাদকে আক্রমণ করছে। তিনি ক্রুশ্চেভের সংস্কার গুলিকে প্রতিক্রিয়াশীল সংশোধনবাদী সংস্কার বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে ক্রুশ্চেভ পরিকল্পিত ওয়ারশ চুক্তি ছিল সোভিয়েত স্বার্থে গঠিত আদর্শহীন নিছক সামরিক জোট।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে সোভিয়েত ছক বিশেষ কার্যকর হয়নি। 1958 খালের দুর্ভিক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চীনকে কোনরকম সাহায্য করেনি। মাও সে তুং চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তৃতীয় বিশ্ব সুলভ মডেল সন্ধানে উদ্যোগী হলেন। তার অভিনব সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রিট লিপ ফরওয়ার্ড সাময়িকভাবে অকার্যকর হলে ক্রুশ্চেভ এই নীতি কে পেটি বুর্জোয়া নীতি বলে সমালোচনা করেন ইতিমধ্যে 1959 সালে সেপ্টেম্বরে ক্রুশ্চেভ মার্কিন মুলুক সফর করলে চীন সোভিয়েত সম্পর্ক আরো খারাপ হয়ে যায়। ক্রুশ্চেভের এই মার্কিন প্রীতিকে চীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পক্ষে ক্ষতিকর বলে অভিহিত করেন। এই প্রেক্ষিতে সোভিয়েত নেতৃত্ব চীন থেকে রুশ বিশেষজ্ঞ ও প্রযুক্তিবিদদের ফিরিয়ে নেয় এইভাবে চীন সোভিয়েত অর্থনৈতিক সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে।
1962 সালে ভারত-চীন সীমান্ত যুদ্ধ কে কেন্দ্র করে চীন সোভিয়েত সম্পর্ক আরো খারাপ হয়। সোভিয়েত প্রশাসন এই যুদ্ধে ভারতের পক্ষ নিল। এর প্রতিক্রিয়ায় 1968র চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত হস্তক্ষেপকে চিন সমালোচনা করে। শত্রুতা এমন জায়গায় চলে যায় যে চীন-সোভিয়েত সীমান্ত সংঘর্ষ পর্যন্ত হতে পারত।
1976 সালে মাও সে তুং এর মৃত্যুর পরেও চীন-সোভিয়েত সম্পর্কে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং সোভিয়েত সমর্থিত ভিয়েতনামি বাহিনীর কাম্বোডিয়া আক্রমণ, চীন-ভিয়েতনাম সীমান্ত যুদ্ধ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণের মতো ঘটনার পরিণতিতে চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক খারাপ হতে থাকলো 1979 সালে চীন 1950 এর গোড়ায় স্বাক্ষরিত চুক্তি নবীকরণ করতেও রাজি হয়নি।
তবে 1980 দশকের গর্বাচেভের সময় থেকে চীন সোভিয়েত সম্পর্ক আবার উষ্ণ হতে থাকে। দুপক্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গর্বাচেভ চীন সফর করেন। দেন জিয়াও পিং মাও সেতুংয়ের চরমপন্থী নীতি থেকে সরে আসেন। চীনের বাজার পুঁজির জন্য মুক্ত হয়। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার গুরুত্ব প্রকাশ পায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন