সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চীন-মার্কিন সম্পর্ক

চীন-মার্কিন সম্পর্ক

দূরপ্রাচ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কোন মতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই প্রথম থেকেই চীন-মার্কিন সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত খারাপ। যদিও 1960 এর দশক থেকে চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক যখন শীতল হতে থাকে তখন থেকে চীন-মার্কিন সম্পর্কের দূরত্ব ক্রমশ কমতে থাকে। তাই চীন মার্কিন সম্পর্ক আমরা দুটি পর্বে বিভক্ত করে আলোচনা করতে পারি।

প্রথম পর্ব (1949-70)

1949 সালে মাও সেতুং এর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন আত্মপ্রকাশ করলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া তো দূরের কথা বরং তাইওয়ানে দক্ষিণপন্থী চিয়াং প্রশাসনকে সর্বতোভাবে সমর্থন করেছিল এবং তাকে চিন দখলের জন্য উৎসাহিত ও সহযোগিতা করেছিল। এমনকি 1950 সালে ডিসেম্বরে মার্কিন বাহিনী তাইওয়ান থেকে চীনের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে আক্রমণ চালিয়েছিল। কোরিয়ার যুদ্ধে মার্কিন বিমানবাহিনীর চীনের আকাশসীমা লংঘন করেছিল। আমেরিকা সরাসরি কমিউনিস্ট চীনকে শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করেছিল এবং তাকে 'সোভিয়েত মাঞ্চুকুয়ো' বলে বিদ্রুপ করেছিল। প্রত্যুত্তরে চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং আমেরিকাকে 'পয়লানম্বর শত্রু' বলে ঘোষণা করেছিল এবং ওয়াশিংটন কর্তৃক গৃহীত সবরকম নীতি ও কর্মসূচির বিরোধিতা করেছিল।

আমেরিকার চীন নীতির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের প্রসার রোধ করা। তার চোখে আসল চীন ছিল তাইওয়ান। আমেরিকা জাপান দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশগুলির সাথে সাম্যবাদ বিরোধী জোট গঠন করেছিল এই প্রেক্ষিতেই ANJUS, SEATO প্রভৃতি আঞ্চলিক সামরিক শক্তি জোট গড়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে 1964 সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন পারমানবিক বোমা বানাতে সক্ষম হয়। ফলে আমেরিকার বেষ্টনী নীতি কিছুটা অকেজো হয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতে 1966 সালে মার্কিন বিদেশসচিব Dean Rusk প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে চীনের কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করার হুমকি পর্যন্ত দেয়।

দ্বিতীয় পর্ব (1970- cont..)

1970 এর দশক থেকে চীনের সঙ্গে আমেরিকা সম্পর্ক ক্রমশ উন্নত হতে থাকে। 60 এর দশক থেকে চীন সোভিয়েত সম্পর্কের অবনতির ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তারই ফলস্বরূপ চীন কিছুটা মার্কিনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। 1971 সালে বিখ্যাত চীন-মার্কিন পিংপং কূটনীতির সূত্রপাত হয়। জুলাই মাসে মার্কিন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জার চীন সফরে যান। পরের বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজে চিনে আসেন। এই সুসম্পর্কের জেরে চীন রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়। 1972 সালে চীন মার্কিন শিখর বৈঠক হয় যেখানে তাইওয়ানসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়। যদিও চীন মার্কিন সম্পর্কের এই উষ্ণতাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোন ভাবেই ভালো চোখে দেখেনি।

মাও সেতুং এর মৃত্যুর পর চীনের রাষ্ট্রপ্রধান দেন জিয়াও পিং আমেরিকা সফর করেন ওই বছরই মার্কিন প্রশাসন চীনকে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে Most Favoured Nation এর মর্যাদা দান করে। এখন থেকে মার্কিন পুঁজি প্রযুক্তি নিয়মিতভাবে চীনে আসতে থাকে 1989 সালের চীন-মার্কিন পারমাণবিক সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তিয়েন আন মিন স্কোয়ারের 4ঠা মে'র ঘটনা আমেরিকাকে বিব্রত করলেও এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

মূলত মার্কিন পূজাকে সামনে রেখে চিন Open door policy চালু করে মার্কিন পুঁজিপতিরা ও বহুজাতিক সংস্থা গুলি বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে চিনে স্বাগত। 1996 সাল নাগাদ জেনারেল মোটরস কোকাকোলার মত পাঁচ হাজারেরও অধিক ছোট-বড় মার্কিন কোম্পানি চীনে রমরমিয়ে বাণিজ্য চালিয়েছে। 1998 সাল থেকে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে হটলাইন টেলিযোগাযোগ, সামরিক সহযোগিতা, পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা প্রভৃতি বিষয়ে যৌথ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

পরিশেষে চীন ও আমেরিকা দুটি দেশ রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শগতভাবে পৃথক সত্তা বজায় রাখলেও অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তারা সেইসব মতপার্থক্য গুলিকে সরিয়ে পুঁজির বিকাশের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে চীন আমেরিকার প্রতি বিরূপ সমালোচনা করলেও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিন্তু সেই সমালোচনার প্রভাব সেভাবে পড়েনা। অনেকেই অবশ্য মনে করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ঠান্ডা লড়াই এর সমাজতান্ত্রিক বাটনটি হয়তো চীন গ্রহণ করে কোন এক সময় এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। দুটি বৃহৎ শক্তি যেভাবে অর্থনৈতিক সমঝোতা ও সহযোগিতার পথে এগোচ্ছে তাতে সেই সম্ভাবনা অতি বিরল বলেই মনে হয়।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...