সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বার্লিন প্রাচীরের ভাঙ্গন: জার্মানির পুন:সংযুক্তিকরণ

বার্লিন প্রাচীরের ভাঙ্গন: জার্মানির পুন:সংযুক্তিকরণ


বিশ্ব রাজনীতিতে একদিকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমিক অবক্ষয় ও পতন হচ্ছিল সেই সময় এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল। বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলা হল এবং জার্মানির পুনঃসংযুক্তিকরণ হল। জার্মানির ইতিহাস সূচনালগ্ন থেকেই নাটকীয় ও ঘটনাবহুল। বহুধাবিভক্ত জার্মান ছোট ছোট রাজ্যগুলি দীর্ঘ লড়াইয়ের পর 19 শতকের শেষভাগে বিসমার্ক এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তারপর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল এবং বলাবাহুল্য দুই মহাযুদ্ধে জার্মানির একক দায়িত্ব অনেকটাই ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছিল এবং ঠান্ডা লড়াই এর ফলে জার্মানি আবার বিভাজিত হয়ে গেছিল। পূর্ব জার্মানির উপর সোভিয়েত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পশ্চিম জার্মানির উপর মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দুই জার্মানির বিভাজন রেখা হিসাবে একশ তিন মাইল বিস্তৃত বার্লিন প্রাচীর তৈরি হয়েছিল। যদিও এই বিভাজনে সাধারণ জার্মান দের কোন সায় ছিল না।

1960 দশকের সময় থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন কিছু নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল। মার্কিন সোভিয়েত সম্পর্কে উষ্ণতা এসেছিল দাঁতাতের রাজনীতির কারণে। পশ্চিম জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সরকারের মার্কিন প্রীতি নানান কারণে অনেকটাই কমে এসেছিল এবং কট্টর সোভিয়েত বিরোধী তার রাস্তা থেকে তারা সরে এসেছিল। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলের নেতা ও উপ-প্ৰধানমন্ত্রী উইলি ব্র্যান্ড 1969 নাগাদ পূর্ব জার্মানির সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল যা Ostopolitik নামে পরিচিত। দুই জার্মানির শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের অবসান এর ফলে উভয় রাষ্ট্রসংঘের সদস্য পদ অর্জন করেছিল এবং স্নায়ুযুদ্ধের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হয়েছিল। এই বিরল কৃতিত্বের জন্য উইলি ব্রান্ড নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এভাবেই দুই জার্মানির মিলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল।

জার্মানির ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয় পরবর্তী জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোল এর সময়ে। তিনি দুই জার্মানির ঐক্যের' কথা দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরেন। এদিকে পূর্ব জার্মানির জনগনও মিলনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। 1989 সাল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নে গর্বাচভ প্রবর্তিত গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা নীতির ফলে যে নতুন হাওয়া বইতে শুরু করেছিল তার প্রভাব পূর্ব জার্মানিতেও পড়ে। পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট দলের অন্তর্বিরোধ দেখা দেয়। বামপন্থীদের মনোবল ভেঙে যায়। গর্বাচেভ ও চাইছিলেন যাতে দুই জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়, কারণ তাতে ইউরোপের রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত হবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে জার্মানিতে আর সৈন্য মোতায়েন রাখতে হবে না। 1989 সালের নভেম্বরে আকস্মিকভাবেই বার্লিন প্রাচীর খুলে দেওয়া হয় দুই জার্মানির মানুষ অতঃপর ঐ প্রাচীর ধুলিস্যাৎ করে দেয়।

এরপর বাকি ছিল কেবল আনুষ্ঠানিক সংযুক্তিকরণ এর প্রক্রিয়া। 1990 সালের নির্বাচনে পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল এবং বিপুল ভোটে জয়ী হলো খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি। 12 সেপ্টেম্বর মস্কোতে গর্বাচেভের উপস্থিতিতে দুই জার্মানির সংযুক্তিকরণ বিষয়ক ঐতিহাসিক চুক্তি Treaty on the Final Settlement on Germany স্বাক্ষরিত হল। 1994 সালের মধ্যে রাশিয়া পূর্ব জার্মানি থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল। জার্মানি ভবিষ্যতে সব ধরনের পরমাণু অস্ত্র এবং জৈব রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণ থেকে বিরত থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল। এভাবে সংযুক্তিকরণ এর লেখালিখি সম্পূর্ণ হল। আতশবাজি, আলোর রোশনাই আর চার্চের ঘন্টাধ্বনির মধ্য দিয়ে মানুষ সেই মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখল। সংযুক্ত জার্মানি রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হলেন হেলমুট কোল।

বার্লিন প্রাচীরের ভাঙ্গন এবং জার্মানির পুনঃসংযুক্তিকরণ এর ঘটনা একদিকে ঠান্ডা লড়াইয়ের শেষ পার্থিব প্রতীক কে বিনষ্ট করল এবং জার্মানির আবার ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পথ সূচিত করল। অন্যদিকে পূর্ব জার্মানিতে সমাজতন্ত্রের অবসান সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...