সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ক্রুশ্চেভ জমানায় সোভিয়েত বলয়ে অসন্তোষ: পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি

ক্রুশ্চেভ জমানায় সোভিয়েত বলয়ে অসন্তোষ: পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি

1953 সালের মার্চ মাসে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে স্ট্যালিনের সংস্কারগুলিকে একের পর এক বাতিল করেন এবং এক আপাত-উদার আদর্শের কথা তুলে ধরেন, যেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বহুমাত্রিকতার কথা বলা হয়। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন ক্রুশ্চেভের স্তালিনবাদ বিরোধিতার নীতি পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত বলয়ের অন্তর্ভুক্ত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলিকে রাজনৈতিক পালাবদলের জন্য বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করেছিল। প্রাথমিকভাবে পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরিতে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল।

পোল্যান্ডে বিদ্রোহ

1956 সালে পোল্যান্ডের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল রাজধানী পোজেন-এ শ্রমিক অসন্তোষজনিত জনবিক্ষোভ থেকে। শ্রমিকদের বিক্ষোভের প্রধান কারণ ছিল কম মজুরি দীর্ঘ কাজের সময় ক্রমাগত কর বৃদ্ধি ও জীবন যাপনের নিম্নমান। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মঘট ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলে পরিস্থিতির বিশেষ অবনতি ঘটে ছিল। বিদ্রোহীদের মূল স্লোগান ছিল 'Bread and Freedom'। শিল্পক্ষেত্রে অস্থিরতার পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং (চেকতচওয়া শহরের) ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ইতিমধ্যে পুলিশ কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সোভিয়েত পন্থী নেতা Boleslav Beirut 1956 সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। ফলে সোভিয়েত বিরোধী গোষ্ঠী উৎসাহিত হয়ে ওঠে এবং স্ট্যালিনের সময় বন্দী হয়েছিলেন এমন টিটোপন্থী কমিউনিস্ট নেতা গোমুলকাকে দেশের নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনার দাবি তুলতে থাকেন। এই দাবিকে কেন্দ্র করে সারাদেশ ক্রমশ উত্তাল হয়ে ওঠে।

এই প্রেক্ষিতে পোলিশ সেনাবাহিনী গণবিদ্রোহ আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হয়। বাধ্য হয়ে রুশীও ট্যাংক আসরে নামে কিন্তু তারা কোন রকম সংঘাতে অগ্রসর হয়নি। এর কারণ সম্ভবত পোল্যান্ডে কোন সামরিক অভিযান ঘাটালে পূর্ব ইউরোপ তথা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় তার তীব্র প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। তাছাড়া গোমুলকাকে নিয়ে ক্রুশ্চেভের তেমন একটা সমস্যা ছিল না কারণ সে ওয়ারশ চুক্তি জোটের বিরোধী ছিলনা এবং মনেপ্রাণে মার্কিনবিরোধী ছিল। তাই দু'পক্ষ একটা সমঝোতায় আসে। ক্রুশ্চেভ এর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী রুশ প্রতিনিধিদল স্থায়ী মীমাংসার জন্য পোল্যান্ডে আসেন এবং বর্তমান পুলিশ পলিটব্যুরো ভেঙে দিয়ে গোমুলকাকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন। পুলিশ কমিউনিটি পার্টি সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে কাজ চালানোর অধিকার পায়। যদিও বৈদেশিক প্রশ্নে রাশিয়ার পরামর্শ মেনে চলার, ওয়ারশ চুক্তি মেনে চলার এবং সরকারে অকমিউনিস্টদের স্থান না দেওয়ার অঙ্গীকার করে।

হাঙ্গেরির বিপ্লব

হাঙ্গেরির বিদ্রোহের পিছনে ছিল স্ট্যালিনপন্থী শাসক রাকোসির স্বেচ্ছাচার ও পরবর্তীকালে ইমরে নেগির অতি উদারপন্থী শাসন। রাকোসি দুটি পর্বে হাঙ্গেরি শাসন করেছিল।1953 সালে ম্যালেকনভের সহযোগিতায় তাকে পদচ্যুত করে ইমরে নেগী ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু 1955 সালে ম্যালেকনভের প্রতিপত্তি হ্রাস পাওয়ায় রাকোসি আবার ক্ষমতায় এসেছিলেন। 1956 সালে ক্রুশ্চেভের আগে পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর এই দুই পর্বে শাসন স্বেচ্ছাচারী ও জনবিরোধী শাসন হিসেবেই পরিচিত। কারণ এই পর্বে প্রায় 2000 হাঙ্গেরিয়ানের প্রাণহানি হয় এবং 20000 জনের কারাদন্ড হয়। ফলে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত বিরোধী জাগরণ গড়ে উঠতে থাকে।

1956 সালে রাকোসি ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং পার্টির সম্পাদক পদে অভিষিক্ত হন অপর এক রুশপন্থী নেতা আর্নো জেরো এবং প্রধানমন্ত্রী হন জনপ্রিয় ইমরে নেগি। ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে নেগি দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় উন্নীত হন। নেগির সমগ্র শাসনকাল ছিল দেশজুড়ে এক উদ্দীপনার পর্ব। জনগণের দাবি ছিল প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সোভিয়েত প্রভুত্ববাদের অবসান। চলতি বছর অক্টোবর মাসে নেগি হাঙ্গেরির জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা ও দেশ থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি সোভিয়েত নেতৃত্বে কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল। সোভিয়েত নেতৃত্ব এই সময় নেগির সাথে সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু অকস্মাৎ ভাবেই নেগি সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের দিনেই (১লা নভেম্বর) ওয়ারশ চুক্তি থেকে সরে আসার এবং নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করার ঘোষণা করেন। একইসঙ্গে একদলীয় শাসনের অবসান ও অবাধ নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। আরো দাবি করেন যে, হাঙ্গেরি থেকে পুরোপুরি সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। 

এমতাবস্থায় সোভিয়েত এর পক্ষে আর সমঝোতার নীতি অবলম্বন করা সম্ভব ছিল না। কারন হাঙ্গেরির দাবিকে মেনে নিলে রাশিয়ার অন্যান্য উপগ্রহ রাষ্ট্রগুলোতেও এই ধরনের দাবি উঠতে পারে এবং এর ফলে পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের পরিসমাপ্তি অবশ্যম্ভাবী হবে। তাই সোভিয়েত একদিকে জানোস কাদেরের নেতৃত্বে একটি বিকল্প বিপ্লবী কৃষক-শ্রমিক সরকার গঠন করে। অন্যদিকে সাঁজোয়া বাহিনী দিয়ে বুদাপেস্ট অবরোধ করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। আমেরিকা থেকে রাষ্ট্রসংঘ সকলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। যদিও নির্জোট আন্দোলনের মঞ্চ থেকে ভারতের নেহেরু সরকার এই ঘটনার জন্য সোভিয়েতকে নিন্দা জানিয়েছিল। হাঙ্গেরির বিদ্রোহ দ্রুততার সাথে দমিত হয়। নেগি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন এবং জানোস কাদারের নেতৃত্বে সোভিয়েতপন্থী সরকার গড়ে ওঠে। 

হাঙ্গেরির ঘটনা প্রমাণ করেছিল যে ক্রুশ্চেভের উদারনীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি প্রকৃতপক্ষে একটা বাইরের আবরণ। আসল লক্ষ্য ছিল কতৃত্ববাদ। তাই ওয়ারশ চুক্তি থেকে সরে আসাটা কোনমতেই ক্রুশ্চেভ সহ্য করতে পারেনি। হাঙ্গেরির নতুন রাষ্ট্রপ্রধান জানোস কাদার সোভিয়েতের আনুগত্যের প্রমাণ স্বরূপ জানিয়েছিল যে, দেশে কোনো নির্বাচন হবে না এবং কোন পরিস্থিতিতে হাঙ্গেরি ওয়ারশ চুক্তি থেকে সরে আসবে না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...