নয়া উপনিবেশবাদের সংজ্ঞা
অব উপনিবেশীকরনের পর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের পরিবর্তিত রূপ ছিল নয়া উপনিবেশবাদ। বিউপনিবেশীকরন প্রক্রিয়ায় এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলি স্বাধীনতা পেয়েছিল বটে, কিন্তু সদ্য স্বাধীন এই দেশগুলি বিভিন্ন কারণে কোনো-না-কোনো বৃহৎ শক্তির পরোক্ষ আধিপত্যের জালে জড়িয়ে পড়েছিল। এই নতুন গোত্রের সাম্রাজ্যবাদ হল উপনিবেশ বিহীন সাম্রাজ্যবাদ। এই ব্যবস্থায় উপনিবেশের অস্তিত্ব না থাকলেও বৃহৎ শক্তির হাতে অর্থনৈতিক অধীনতা রয়ে গেল। মাইকেল ব্যারাটের ভাষায় ''Imperialist control, now depends more on economic domination than on political rule''.
নয়া ঔপনিবেশিক আধিপত্যের কোন একক কৌশল ছিল না। কৌশলগুলি ছিল যেমন সূক্ষ্ম তেমনি বিচিত্র। ঘানার রাষ্ট্রপ্রধান নক্রুমা তার Neo Colonialism: The Last Stage of Capitalism গ্রন্থে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিকে নয়া উপনিবেশবাদ সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন এই নয়া-ঔপনিবেশিক কৌশলগুলি মূলত অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেও রাজনৈতিক, মতাদর্শগত এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হয়।
নয়া উপনিবেশবাদের কৌশল
নয়া উপনিবেশবাদী কৌশলগুলিকে নিম্নলিখিত ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
১) সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলির রাজনৈতিকভাবে এতটাই দুর্বল এবং ওস্থিতিশীল ছিল যে তাদের টিকে থাকার জন্য বাইরের শক্তির সাহায্য ও সমর্থন দরকার হতো এভাবে বৃহৎ শক্তিগুলো উক্ত দুর্বল রাষ্ট্রকে রক্ষা করার নামে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিকে বিশেষত অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত।
২) সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বা দুর্বল দেশগুলি প্রায়শই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ত। যেমন ভারত ও পাকিস্তান সংঘর্ষ। এই দেশগুলি যুদ্ধ পরিচালনার প্রয়োজনে সমরাস্ত্র সংগ্রহের জন্য বৃহৎ শক্তির উপর নির্ভরশীল থাকত। কারণ তারাই ছিল একমাত্র অস্ত্রপ্রস্তুতকারী দেশ। অস্ত্রপ্রস্তুতকারী দেশগুলি এভাবে সমরাস্ত্রের ব্যবসা ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছিল। এইজন্য সীমান্ত সংঘর্ষ গুলিকে তারা উস্কানিও দিত।
৩) তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলির প্রধান সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক সমস্যা। বেকারত্ব, শিল্পহীনতা প্রভৃতি সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে তারা প্রায়ই বৈদেশিক সাহায্যের দিকে ঝুঁকে পড়ত। আমেরিকার মত বৃহৎ শক্তিগুলো এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে মুক্ত বাণিজ্যের অছিলায় পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণে আবদ্ধ করেছিল। আন্তর্জাতিক ঋণদান এবং অর্থনৈতিক সাহায্য প্রাপ্তির অন্যতম দুটি সংস্থা হল IMF ও World Bank. দুর্বল দেশগুলিকে অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভর করে রাখার ক্ষেত্রে এই দুটি সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
৪) তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিকে নিজের প্রাধান্যের অধীনে রাখার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বৃহৎ শক্তিগুলো ঐ সমস্ত দেশগুলিতে বা তার চারপাশে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমেরিকা তাইওয়ানে এরকম সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছিল।
৫) নয়া উপনিবেশবাদের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল বাজার অর্থনীতি ও পুঁজির বিশ্বায়ন। এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন। এগুলি হল GATT, WTO প্রভৃতি।
৬) বহুজাতিক সংস্থা গুলিও একইভাবে নয়া উপনিবেশবাদের বিস্তারে সহায়কের ভূমিকা পালন করেছিল। সমৃদ্ধ দেশগুলির বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এই সমস্ত ধনকুবের প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠে যে এরা মুনাফা লাভের স্বার্থে সেই সমস্ত দেশের সরকারের নীতি নির্ধারণকেও প্রভাবিত করে থাকে। এমনকি সরকারি নীতি যদি তাদের পরিপন্থী হয় তাহলে কৌশলে তারা উক্ত সরকারকে উৎখাত করতেও দ্বিধা করে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন