সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইয়ল্টা সম্মেলন ও পটসডাম সম্মেলন

ইয়ল্টা সম্মেলন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পতন আসন্ন হয়ে উঠলে 1945 সালের 4-11 ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত রাশিয়ার ইয়াল্টায় একটি ত্রিশক্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সম্মেলনের সংগঠক ও স্বাক্ষরকারী 3 বিশ্ব নেতা ছিলেন-  ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী চার্চিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান স্তালিন। এই বৈঠকের প্রধান দুই বিচার্য বিষয় হলো যুদ্ধোত্তর ইউরোপের পুনর্বিন্যাস ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত। এই সম্মেলনে পূর্ব প্রাচ্যে জাপানের সামরিক তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিশেষ চিন্তাভাবনা চলে এবং রুজভেল্টের অনুমতিক্রমে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান স্তালিন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এর বিনিময়ে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র পোর্ট আর্থার শাখালিন ও কিউরাইল দ্বীপপুঞ্জ রাশিয়াকে ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়।


 ইয়াল্টা সম্মেলনে জার্মানিকে বিভাজিত করার মধ্য দিয়ে ওই দেশ থেকে নাৎসি প্রভাব পুরোপুরি নির্মূল করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সূত্র ধরে বলা হয় জার্মানির নিয়ন্ত্রণমুক্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিকে সাধ্যমত সাহায্য দান করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট দেশসমূহে উদার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

স্থির হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যেসব রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তারা একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হবে এবং প্রস্তাবিত রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের তারা স্থায়ী সদস্য হবে। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির প্রয়োজনে ভেটো দানের অধিকার থাকবে। স্ট্যালিনের এ বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ না থাকলেও তিনি তার বিদেশমন্ত্রী মলোটভকে 1945 সালের এপ্রিলে সানফ্রান্সিসকোতে আহুত বিশ্ব সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসাবে পাঠালে মলোটভ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ঐতিহাসিক সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন।

এই সম্মেলনে বেশ কয়েকটি বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন এর বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ছিল। যুদ্ধের পরিসমাপ্তির সাথে সাথেই সমগ্র পোল্যান্ড পুরোপুরি সোভিয়েত লালফৌজের হাতে চলে গেলে স্তালিন পোল্যান্ডের অধিকার ছাড়তে প্রস্তুত ছিলেন না। দীর্ঘ বিতর্কের পর উভয় পক্ষই পোল্যান্ডের বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যেখানে বলা হয় নিকট ভবিষ্যতে বৃহত্তর পরিসরে যে পলিশ সরকার গঠিত হবে সেখানে অন্যান্যদের পাশাপাশি লন্ডনের পোলরাও স্থান পাবে। আরো বলা হলো যে এই অন্তর্বর্তীকালীন পোলিশ প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আগামী দিনে নির্বাচনের মাধ্যমে স্থায়ী পোলসরকার গঠিত হবে

প্রসঙ্গত উল্লেখ্যযোগ্য, ফ্যাসিবাদী শক্তির চূড়ান্ত পরাজয়কে গুরুত্ব দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মতবিরোধ জনিত একতরফা সোভিয়েত বিরোধী মনোভাব কে প্রশ্রয় দেননি। যদিও রুজভেল্ট এর মৃত্যুর পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান এর মত মার্কিন কূটনীতিকরা রুজভেল্টের সমঝোতার নীতি বর্জন করে কট্টর সোভিয়েত বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন যা পরিণতিতে ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছিল।


পটসডাম সম্মেলন

জার্মানির আত্মসমর্পণের পর জার্মানির বার্লিনের কাছে পটসডাম শহরে আয়োজিত হয় পটসডাম সম্মেলন (১৯৪৫,জুলাই)। এটি ছিল মিত্রপক্ষের শেষ সম্মেলন, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমি শক্তিগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়, যার ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এসেছেন কট্টর সোভিয়েত বিরোধী হ্যারি ট্রুম্যান, যার উদ্যোগে পারমাণবিক গবেষণায় বিশেষ গতি এসেছিল। সম্মেলন চলাকালে 24 জুলাই তিনি জাপানের ওপর আণবিক বোমা নিক্ষেপের নির্দেশ জারি করেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে এই বোমা নিক্ষেপ ছিল অনাবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে দূরপ্রাচ্যে সোভিয়েত এর প্রভাব যাতে কোনভাবে না গড়ে ওঠে তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

আমেরিকা,ব্রিটেন, ফ্রান্স,চীন,সোভিয়েত রাশিয়া- এই পঞ্চশক্তির যোগদান জনিত পটসডাম সম্মেলনে প্রায় প্রতিটি বিষয়েই সোভিয়েত প্রতিনিধির সঙ্গে পুঁজিবাদী পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিদের তীব্র মনোমালিন্য দেখা দেয়। এই সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:- 1. পরাজিত জার্মানিকে চারটি অঞ্চলে বিভাজিত করার ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ। স্থির হল যুদ্ধ অপরাধী জার্মানি যে ক্ষতিপূরণ দেবে তার সিংহভাগ পাবে রাশিয়া। 2. বিশেষ করে পোল্যান্ডের প্রশ্নে সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন এর মধ্যে তীব্র বিবাদ দেখা দিল। সোভিয়েত লালফৌজ ওডার-নিস সীমান্তের পূর্বদিকের জার্মান ভূখণ্ড দখল করে নেওয়ায় ব্রিটেন ও আমেরিকা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। 3. সম্মেলনে ইতালির দখলে আসা ট্রিয়েস্টকে যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া এবং আফ্রিকায় ইতালির উপনিবেশ ত্রিপলিকে সোভিয়েত অছি শাসনাধীনে আনার রুশ প্রস্তাব পশ্চিমী শক্তিগুলির সম্মিলিত বিরোধীতার দরুন ভেস্তে যায়। 4. সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভ গ্রীসে বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পাঠানোর তীব্র সমালোচনা করেন। সর্বোপরি, সম্মেলনের সমাপ্তির চার দিনের মধ্যে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটির ওপর আমেরিকার আণবিক বোমা বর্ষণ ও তার পরিণতিতে সংঘটিত ধ্বংসলীলা রুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্তালিনকে মার্কিন বিদ্বেষী করে তোলে। প্রবল মতভেদ, বাদানুবাদ, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দোষারোপের মধ্য দিয়ে পটসডাম সম্মেলনের অবসান দু'পক্ষের ঠান্ডা লড়াইকে অবশ্যম্ভাবী ও দীর্ঘমেয়াদি করে তুলেছিল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ