তৃতীয় বিশ্বের সংজ্ঞা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রকোপ বেড়ে চলেছিল, সেই প্রেক্ষিতেই তৃতীয় বিশ্বের (Third World) অভ্যুদয় ঘটে ছিল। Third World শব্দবন্ধ প্রথম ব্যবহার করেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রাক্তন মহাসচিব ড্যাগ হ্যামার্সজোল্ড (Dag Hammerskjold)। তিনি এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দরিদ্র ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলিকে বোঝাতেই তৃতীয় বিশ্ব শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। পিটার ক্যালভোকোরেসি অবশ্য তৃতীয় বিশ্ব বলতে মার্কিন এবং সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত দ্বিখন্ডিত বিশ্বের ধারণাকে যে সমস্ত দেশ নস্যাৎ করে দিয়েছিল তাদেরকেই বুঝিয়েছেন। সুতরাং তৃতীয় বিশ্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ অত্যন্ত জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তৃতীয় বিশ্ব বলতে যে সমস্ত দেশগুলিকে বোঝায় সেগুলির বেশিরভাগই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত। ডি-কলোনাইজেশন এর ফলস্বরূপ যে সমস্ত দেশ সাম্রাজ্যবাদী পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়েছিল তাদের একাধিক আর্থ-রাজনৈতিক-সমাজিক সমস্যা ছিল, যেমন দারিদ্র, অপুষ্টি, অশিক্ষা, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক পশ্চাদগামিতা, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, নয়া-উপনিবেশবাদের প্রভাব, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, বর্ণবৈষম্য প্রভৃতি। তবে এমনও অনেক দেশ ছিল যারা কখনোই ঔপনিবেশিক পরাধীনতার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে নি অথচ উপরিউক্ত সমস্যাগুলোতে জর্জরিত ছিল। আবার মহাচীনের মত দেশ সদ্য স্বাধীন হওয়ার পর দ্রুতগতিতে তার অগ্রগতি ঘটিয়েছিল। কয়েকটা ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল যে এরা অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির সমাধানকল্পে মার্কিন পুঁজিবাদী গোষ্ঠী এবং সোভিয়েত সাম্যবাদী গোষ্ঠীর কোনটারই অন্তর্ভুক্ত না হয়ে উভয় জোট থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে স্বাধীনভাবে এগিয়ে চলার নীতি গ্রহণ করেছিল। তবে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র মানেই সে তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত এমনটাও নয়। কারণ সোভিয়েত সাম্যবাদী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এমনও অনেক রাষ্ট্র ছিল যারা উপরিউক্ত আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত ছিল।
সুতরাং রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যাবেনা। যদি অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তৃতীয় বিশ্বকে ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে এক কথায় বলা যায় বিশ্বের বিশেষত এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলিই তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত। ইহাই সম্ভবত বেশি গ্রহণযোগ্য।
তৃতীয় বিশ্বের প্রকৃতি
1. বিশ্বের জনসংখ্যা ও সম্পদের বন্টনে তৃতীয় বিশ্ব ছিল অসম্ভব পিছিয়ে পড়া। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ ছিল তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত। কিন্তু GNP (Gross National Product) অনুসারে এইগুলি বিশ্বের মাত্র ২০ শতাংশ পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনে সক্ষম। তাই দারিদ্র ও অনটন একবিংশ শতাব্দীতেও তৃতীয় বিশ্বের নিত্যসঙ্গী। সম্ভবত এজন্যই তৃতীয় বিশ্বের মানুষজন প্রায়ই প্রোটিন ও ভিটামিনের ঘাটতির শিকার হয়।
2. তৃতীয় বিশ্ব নিজের অস্তিত্ব ও বিকাশের স্বার্থে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী লড়াইয়ে আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত পৃথিবীর ধারণাকে বর্জন করেছিল। এর কারণ সম্ভবত দুই পরমাণু শক্তিধর সুপার পাওয়ারের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল ছিল এবং উভয়ের মধ্যে কোনো বিধ্বংসী যুদ্ধ হলে তা থেকে তারা দূরে থাকতেই চাইত। পাল্টা মঞ্চ হিসাবে তৃতীয় বিশ্ব জোট নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছিল, যার প্রাণপুরুষ ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। এভাবেই দেখা যায় যে তৃতীয় বিশ্বভুক্ত দেশগুলিতে কমিউনিস্ট মতাদর্শ বা পুঁজিবাদী চরম দক্ষিণপন্থা কোনোটাকেই আদর্শস্থানীয় বলে মনে করা হয়নি।
3. দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশই দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ The Brandt Report নামে পরিচিত একটি বিশেষ প্রতিবেদনে তৃতীয় বিশ্বের অবস্থা ও সমস্যা গুলি আলোচনা প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম জানান যে পৃথিিবী আসলে দুটি অংশে বিভক্ত-- উত্তর ও দক্ষিণ। ঘটনাচক্রে অধিকাংশ ধনী ও উন্নত দেশগুলি উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত এবং তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দুর্বল ও দরিদ্র দেশ সমূহের অবস্থান দক্ষিণ গোলার্ধ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন