মনসবদারি ব্যবস্থা
মনসব কথার আক্ষরিক অর্থ কোনো একটা জায়গা যেখানে কিছু লাগানো বা সাটানো আছে। মুঘল শাসন ব্যবস্থায় মনসব বলতে পদমর্যাদা বোঝাত। মনসবদারি ব্যবস্থা মুঘল সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, যেখানে একজন মনসবদার কে বেতন বা জাগিরের বিনিময় সম্রাটের জন্য সেনাবাহিনী পোষণ করতে হত। যেহেতু মুঘলদের নিরবচ্ছিন্নভাবে সামরিক অভিযানে লিপ্ত থাকতে হতো, তাই মনসবদারি ব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের প্রধান ভিত্তি।
ভারতে মনসবদারি ব্যবস্থার প্রবর্তক হলেন মুঘল সম্রাট আকবর। যদিও এই ব্যবস্থার শিকড় ছিল পারস্যে। বাবর তার সামরিক অফিসারদের মধ্যে জমি বন্টন করে দিতেন। কিন্তু তা মনসবদারি ব্যবস্থা ছিল না, তা ছিল অনেকটাই ওয়াঝ ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনীয়। শিরিন মুসাভীর গবেষণায় দেখা গেছে আকবরের রাজত্বকালে চারটি পর্বে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মনসবদারি ব্যবস্থা তার পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। প্রথমত, আকবরের রাজত্বকালের প্রথম দশ বছর পর্যন্ত সামরিক অফিসারদের মাইনে ইচ্ছামত ঠিক করা হতো এবং তাদের হাতে কত সংখ্যক ঘোরসওয়ার থাকবে তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। দ্বিতীয়তঃ 1566-67 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রতিটি মনসবদারের অধীনস্থ জাগিরের আয় অনুযায়ী তাদের ঘোড়সওয়ার সংখ্যা এবং মাইনে স্থির করা হলো। তৃতীয়তঃ 1573-74 নাগাদ পদাধিকারীদের একটি করে সংখ্যা দেয়া হলো, যা থেকে বোঝা যাবে তাদের মাইনে কত এবং কত মালবাহী পশু তারা রাখবে। এর জন্য আগাম কিছু টাকা দিয়ে দেওয়া হল। ওদের ঘোড়া পরীক্ষা করে দাগ দেওয়া শেষ হলে বাকি টাকা দেওয়া হতো। চতুর্থত: 1595-96 নাগাদ মনসবদারদের তিনটি ভাগে ভাগ করা হলো- ১) যাদের ঘোড়সওয়ার সংখ্যা তাদের মনসবের সমান, 2) যাদের ঘোড়সওয়ার সংখ্যা তাদের মনসবের অর্ধেক বা তার বেশি এবং 3) যাদের ঘোড়সওয়ার সংখ্যা তাদের মনসবের অর্ধেকেরও কম। এরপর ঘোড়সওয়ারদের মাইনের সূচক আলাদা একটা সংখ্যা দেওয়া হল। এইভাবে মনসবদাররা পদমর্যাদার সূচক হিসাবে দ্বৈত সংখ্যার অধিকারী হলো যা জাট ও সওয়ার নামে পরিচিত। সুতরাং আতাহার আলীর ভাষায়, জাট হল মনসবদার ব্যক্তিগত পদমর্যাদা ও মাইনে এবং সওয়ার হলো তার অধীনস্থ ঘোড়সওয়ার সংখ্যা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য সাধারণভাবে জাট সংখ্যার তুলনায় সওয়ার সংখ্যা কম হত। যার সওয়ার সংখ্যা যত বেশি হত তাকে তত ভালো মনসবদার হিসেবে মনে করা হতো।
আবুল ফজলের রচনা থেকে জানা যায় প্রায় 66 টি গ্রেডে মনসবদার নিয়োগ করা হতো। সাধারণত 10 থেকে 5000 ই মনসব দেওয়া হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে 7000 ই এবং 10000 ই মনসব দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁরা ছিলেন বাদশাহের খাস ব্যক্তি। জাট সংখ্যার ভিত্তিতে মনসবদাররা দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। 1000 বা তার বেশি পদমর্যাদা হলে তিনি উচ্চ মনসবদার বা উমরা এবং এক হাজারের নিচে হলে তিনি নিম্ন মনসবদার। যদিও নিম্ন মনসবদারের সংখ্যাই বেশি ছিল।
মনসবদার নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি, বদলি এবং বরখাস্ত পর্যন্ত সমস্ত কিছুই সম্রাটের ইচ্ছাধীন ছিল। মনসবদার পদ বংশানুক্রমিক ছিলনা। সম্রাট চাইলে অবশ্য উত্তরাধিকারী নির্বাচন করতে পারতেন। একজন মনসবদারের মৃত্যুর পর তার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো। যদিও তার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্রাট নিতেন। তাই মনসবদারদের কোনরকম সঞ্চয় প্রবণতা ছিল না।
মনসবদারি ব্যবস্থায় যাতে দুর্নীতি না হয় তাই আকবর দাগ ও চেহারা প্রথা চালু করেছিলেন। দাগ হল ঘোড়াকে চিহ্নিত করার প্রথা এবং চেহারা হলো ঘোড়সওয়ারের চেহারার বিবরণ লিখে রাখা। এই পরীক্ষা অতিক্রম করতে না পারলে মনসবদার দের বেতন আটকে দেওয়া হতো। ওই একই কারণে জাগীরদারদের নিয়মিত বদলি করা হতো।
মনসবদারদের বেতন দেওয়া হতো দু ভাবে। যে সমস্ত মনসবদার নগদে বেতন পেতেন তারা নগদি মনসবদার হিসেবে পরিচিত হতেন। আবার অনেককে নগদে বেতনের পরিবর্তে জাগীর দেওয়া হতো। এরা জাগীরদার নামে পরিচিত হতো। জাগীরদার ছিল দুই প্রকার। পাইবাকি জমি থেকে জাগীর দেওয়া হলে তাকে তানখা জাগীর বলা হত। এটি ছিল সাধারণ জাগীর প্রথা। তবে আকবরের শাসনকালে বেশকিছু প্রান্তীয় এলাকা বোঝাপড়ার মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সেই সমস্ত এলাকায় পূর্বতন শাসকরা কার্যত স্বাধীনভাবে শাসন করত এবং তারা সম্রাটের দরবারে উচ্চ রাজপদ লাভ করেছিল। এই সব দেশীয় রাজারা জাগীর হিসাবে নিজের রাজ্যকেই ভোগ করতো। এই ধরনের জাগীর ওয়াতন জাগীর নামে পরিচিত।
আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি ব্যবস্থায় একাধিক ত্রুটি ছিল। যেমন জাগির হিসেবে যে জমি দেওয়া হত তাতে জমার তুলনায় হাসিল সবসময়ই কম হতো। এর ফলে জাগীরদারদের রাজস্ব আদায়ে কঠোরতা অবলম্বন করতে হতো। দ্বিতীয়তঃ জাগীরদারদের সম্রাট ইচ্ছামত বদলি করার ফলে তারা সেই এলাকায় উন্নয়নের তুলনায় লুটপাটে বেশি গুরুত্ব দিত। ফলে কৃষির উন্নতির বাধাপ্রাপ্ত হত। এসব সত্ত্বেও বলা যায় মনসবদারি ব্যবস্থা ও অভিজাত শ্রেণী ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি। যতদিন এই ব্যবস্থাকে সচ্ছল ভাবে টিকিয়ে রাখা গেছিল ততদিন মোগল সাম্রাজ্যে কোনো ক্ষতি হয়নি।
Thankew sir .kalke net er problem er janna class ta korte perlum na.daklum sir notesta.
উত্তরমুছুনThank you sir 🙏
উত্তরমুছুন